মানব প্রকৃতি কি জন্মগত, না পরিবেশগত? - অপার্থিব এই প্রশ্নটি যুগযুগ ধরে সনাতনী দার্শনিকদের ভাবিয়ে এসেছে । প্রশ্নের উত্তর অনুযায়ী তাঁরা দু দলে বিভক্ত ছিলেন। একদল মনে করতেন মানুষ জন্ম নেয় একটা স্বছ্ব স্লেটের মত, জন্মের পর সময়ের সাথে পরিবেশ ও পারিপার্শিকতা ঐ স্বছ্ব স্লেটে মানুষের স্বভাব লিখতে থাকে। ব্রিটিশ দার্শনিক লক (John Locke) এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন। এখনও অনেকে বিশেষ করে যাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার অভাব তাঁরা এই মতবাদে বিশ্বাস করেন। বলাই বাহুল্য যে এর বিপরীত মতবাদীরা মনে করেন যে কেবল বংশাণু ই মানুষের স্বভাব নির্ধারণ করে, পরিবেশের কোন প্রভাব নেই। এই দুই চরম অবস্থানের মতবাদীদের যথাক্রমে পরিবেশ নির্ণয়বাদী ও বংশাণু নির্ণয়বাদী বলা হয়। বর্তমান বিজ্ঞানের আলোকে এই দুই চরম অবস্থানই ভ্রান্িতপূর্ণ । যদিও চরম বংশাণু নির্ণয়বাদীর সংখ্যা এখন হাতেগোণা, চরম পরিবেশ নির্ণয়বাদীর সংখ্যা নগণ্য নয়। অদর্শগত ও রাজনৈতিক শুদ্ধতার কারণে অনেকে এই মতবাদে বিশ্বাস করেন বা এর প্রচারে লিপ্ত হন, বিজ্ঞানের প্রমাণ বা সাক্ষ্যের তোয়াক্কা না করে। সাম্যবাদীরা পরিবেশ নির্ণয়বাদকে পছন্দ করেন কারণ তা তাদের সাম্যবাদের বাণী প্রচারে সহায়তা করে। আর এ কারণেই মার্ক্স্ তাঁর অনেক বাণীতেই এটাই জোরের সাথে বলেছিলেন যে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যই পরিবেশের ফল। পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিন মার্ক্সসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে বংশাণহগুবিদ্যাকে বিকৃত করতেও পেছপা হননি । এই উদ্দেশ্যে তিনি লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। যখন ভাভিলভ প্রমুখ সৎ বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদেরকে গুলগে পাঠিয়ে দেন। যাহোক বংশাণুবিদ্যা ও øায়ূমনোবিজ্ঞানের সৌজন্যে আমরা এখন জানি যে উভয়ই অবদান রাখে মানুষের স্বভাব গঠনে। উভয়ের অবদান থাকলেও তা প্রতিসাম্যমুলক নয়, বংশাণবিক অবদানই মুখ্য। অনেকে উভয়ের অবদানের বাস্তবতা জানলেও এ সম্পর্কে এক অতিসরলীকৃত ধারণা পোষণ করেন। তারা পরিবেশের অবদানকেই মুখ্য বলে বিবেচনা করেন। আচরণের উপর বংশাণুর প্রভাবকে স্বীকার করতে তারা অস্বস্তি বোধ করেন। অথচ বহু বছরের গবেষণায় এটা পরিষ্কার যে gene manipulation বা বংশাণুর নড়চড়ের (যেমন selective breeding বা বৃত প্রজনন) দ্বারা নিম্ন স্তরের প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসন, নমনীয়তা, ক্ষিপ্রতা বা শ্লথতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে তারতম্য ঘটান সম্ভব। অথচ মানুষ এক বিশেষ প্রাণী হওয়া সত্বেও তার বেলায় এই সত্যটি (অর্থা মানব স্বভাবের তারতম্য যে বংশাণুজনিত তফাতের কারণে হতে পারে) মানতে রাজি নয় চরম পরিবেশ নির্ণয়বাদীরা। এই রচণায় পরিবেশ আর বংশাণু এই দুই অবদানের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমার লেখার ভিত্তি হবে মস্তিষ্কবিজ্ঞান ও বিবর্তনী মনোবিজ্ঞানয়ের উপর বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। এই জ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানি যে মানুষের স্বভাবের নিয়ামক হছে মস্তিষ্ক। সঠিকভাবে বলতে হলে মস্তিস্কের কোটি কোটি স্নায়ূকোষের পারস্পরিক সংযোগকারী বর্তনীসমূহ(Synaptic Circuits)। এই বর্তনী গঠিত হয় বংশাণুর নিয়ন্ত্রণে। বর্তনীর সিংহভাগই ভ্রূণে থাকা অবস্থায় তৈরী হয়ে যায়। এই পর্যায়ে বংশাণুতে নিহিত তথ্যই মূল ভূমিকা নিয়ে থাকে। ভ্রূণের অভ্যন্তরের পরিবেশও অবশ্য বংশাণুর পরিস্ফুটনে (Gene Expression) এ সহায়তা করে। মস্তিস্কের বাকি øায়ূগুলির যোগসূত্র সাধিত হয় জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবেশের প্রভাবে । কিন্তু যে কথাটা মনে রাখা দরকার এবং যা অনেকেই উপলব্ধি করেননা সেটা হল যদিও বলা হছে যে জন্ম পরবর্তী মস্তিস্কের অভিব্যক্তি হয় পরিবেশের প্রভাবে কিন্তু এর আসল নিয়ামক হল বংশাণু। ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। একই পরিবেশীয় উদ্দীপক দুই ভিন্ন মস্তিস্কে একই ভাবে বা একই মাত্রায় বংশাণুর পরিস্ফুটন ঘটায় না। ঘুরিয়ে বললে, কোন বিশেষ পরিবেশীয় উদ্দীপকের চাপে মস্তিষ্ক কিভাবে প্রভাবিত হবে বা প্রতিক্রিয়া করবে তা সেই মস্তিষ্কের অধিকারীর বংশাণুর দ্বারাই নির্ধারিত হয়। তাই একই পরিবেশে বেড়ে উঠেও দুই ব্যক্তি ভিন্ন চরিত্রের অধিকারী হয়। এই সত্যটি খুব পরিস্কার ভাষায় লিখেছেন প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্লার্ক তাঁর বই ‘‘Are we Hardwired?‘‘ (আমরা কি জন্মসূত্রে নিয়ন্ত্রিত?) এর ২০ পৃষ্ঠায় যেখানে তিনি মানুষের আচরণের তিনটি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন : "Naturally occurring differences between individuals in the genes regulating any of these processes may well explain differences in the way different people react to the same external situation". (বিভিন্ন ব্যক্তির এই তিনটি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী বংশাণুগুলির মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্যই ব্যাখ্যা দেয় কেন তারা একই পরিবেশের প্রভাবে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে)। যে তিনটি প্রক্রিয়ার কথা বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি হল : (১)পরিবেশের উদ্দীপক সম্পর্কে মস্তিস্কের ধারণা (২)সঞ্চিত স্মরণশক্তির সাহায্যে ঐ উদ্দীপকের প্রক্রিয়াকরণ এবং (৩) পরিবেশের উদ্দীপকরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকরণ। আর এক বিজ্ঞানী, M.I.T বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার তাঁর বই : ""The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature'' এর ১০২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : "Neuroscience is showing that the brain's basic architecture develops under genetic control. Brain systems show signs of innate specialization and cannot arbitrarily substitute for one another" (স্নায়ূবিজ্ঞান এটাই বলছে যে মস্তিস্কের মৌলিক বিকাশ ঘটে বংশাণুর নিয়ন্ত্রণে। মস্তিস্ক সমূহ তাদের নিজ নিজ জন্মগত পার্থক্যের সাক্ষর বহন করে, এক মস্তিস্ক অপর কোন মস্তিস্কের প্রতিনিধিত্ত্ব কখনই করতে পারেনা ) আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে মানুষের স্বভাব বিকাশে বংশাণুর প্রভাবই মুখ্য। এবং কোন কোন বৈশিষ্ট্য শুধু বংশাণুর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, পরিবেশের কোন প্রভাব এই বৈশিষ্ট্যতে পড়ে না। এর সমর্থন মেলে অভিন্ন যমজ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে। উইলিয়াম ক্লার্ক তাঁর ""Are We Hardwired" এর ১৮-১৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে অভিন্ন যমজেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে লালিত হয়েও এক আশ্চর্য্যজনক সাদৃশ্য প্রদর্শন করে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ভিন্ন পরিবেশে অভিন্ন যমজদের মধ্যে সাদৃশ্য আনয়নে বংশাণুর ভূমিকা যমজ নয় এমন দুই ব্যক্তির মধ্যে সাদৃশ্য আনয়নে অভিন্ন পরিবেশের ভূমিকার চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী। স্টিভেন পিঙ্কারও তাঁর ""How the Mind Works'' (কেমন করে মস্তিস্ক কাজ করে) এর ২০ পৃষ্ঠায় যমজদের মধ্যে মিলের বংশাণুগত কারণের উপর জোর দিয়েছেন। স্টিভেন পিঙ্কার তাঁর পূর্বোল্লিখিত ""The Blank Slate'' বইয়ের ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে অভিন্ন যমজদের মধ্যে প্রাণদন্ড, ধর্ম ও অন্যান্য বিতর্কিত সামজিক বিষয়ে চিন্তাধারায় এক অদভূত মিল দেখা যায়। অন্যদিকে অসদ্ যমজ, যাদের বংশাণু ভিন্ন বা দুই ভাই/বোন যারা অভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠে তাদের মধ্যে প্রায়ই দিন রাতের মত তফাত পরিলক্ষিত হয়। সারকথা হল কোন কোন মানব বৈশিষ্ট্য বংশাণু দ্বারা নির্ধারিত, আর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি বংশাণু ও পরিবেশের যৌথ ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট। মানুষের স্বভাবের প্রবণতাগুলি (Propensities) বংশাণুর পরিস্ফুটনের ফল। হার্ভার্ড এর প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী এড্ওয়ার্ড উইলসন তাঁর ‘‘প্রকৃতির সন্ধানে’’ (In Search of Nature) বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : "What the genes prescribe is not necessarily a particular behaviour but the capacity to develop certain behaviours and more than that, the tendency to devlop them in various specified environments" (বংশাণু যে কোন বিশেষ আচরণ নির্ধারণ করবে এমনটি সব সময় নয়, বংশাণু যা করে তা হল কোন কোন আচরণের প্রবণতাকে সৃষ্টি করা, বিশেষ করে নির্দিষ্ট পরিবেশে ঐ প্রবণতাগুলিকে তৈরী করা) অনেক পরিবেশ নির্ণয়বাদীরা বলে থাকেন মানুষ জন্ম সূত্রে খারাপ নয়, খারাপ পরিবেশই তাকে খারাপ করে। এই উক্তিতে একটা অসঙ্গতি আছে। যদি কোন মানুষ খারাপ না হয় তাহলে পরিবেশ খারাপ হয় কি ভাবে? পরিবেশ ত মানুষেরই সৃষ্ট। আর পরিবেশ বলতে চারিপাশের মানুষকেই ত বোঝান হয়, নিশ্চয় গাছপালা নদনদী নয়। পরিবেশ ও মানুষের ক্ষেত্রে মুরগী আগে না ডিম আগে এই প্রশ্ন প্রযোজ্য নয়। পরিবেশ মানুষের সৃস্টি। মানুষের সমন্নয়ে গঠিত। কাজেই পরিবেশের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম তার গঠনকারী মানুষের বৈশিষ্ট্য বা ধর্মকেই প্রতিফলিত করে। এক অর্থে পরিবেশ হল কোন জনগোষ্ঠির সকল মানুষের মস্তিস্কের সমষ্টিগত ফল যা প্রত্যেক মস্তিস্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে। যেহেতু মস্তিস্ক নিজে বংশাণুর দ্বারা নির্ধারিত হয়, তাই চূড়ান্ত বিচারে পরিবেশও ওই জনগোষ্ঠির বংশাণুসমষ্টির (Gene Pool) দ্বারা সৃষ্ট। এড্ওয়ার্ড উইলসন তাঁর পূর্বোল্লিখিত ‘‘প্রকৃতির সন্ধানে’’ বইতে আরও লিখেছেনঃ পৃঃ ১০৭: ‘‘সংস্কৃতি একটি জীববৈজ্ঞানিক উৎপাদন।’’ পৃঃ ১১০: ‘‘মোদ্দা কথা, সংস্কৃতি জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট আর বিবর্তিত হয় আবার জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফলে প্রভাবিত হয়।’’ উইলসন একথাও উল্লেখ করেছেন যে বংশাণুই এপিজেনেটিক সূত্র (Epigenetic rules) নির্ধারণ করে। এপিজেনেটিক সূত্র হল কোন পরিবেশীয় উদ্দীপনে কোন øায়ু বর্তনী তৈরী হবে তার ফর্মূলা। অর্থাৎ মানুষের আচরণ বা স্বভাবে পরিবেশের প্রভাব সত্য হলেও বংশাণুর হেরফের এর দরুন একই পরিবেশ বিভিন্ন মানুষকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে, যে কথাটি পূর্বেও উল্লেখ করেছি। যদিও পরিবেশ জনগোষ্ঠির বংশাণুসমষ্টির দ্বারা সৃষ্ট, কিন্তু একথাটি জানা দরকার যে সময়ও এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ গুণক। বর্তমান পরিবেশ কেবল বর্তমান জনগোষ্ঠির বংশাণুসমষ্টিরই ফলশ্রুতি নয়, বিবর্তনেরও একটা ভূমিকা আছে এখানে। তাই সঠিক ভাবে বলতে হলে বর্তমান পরিবেশ হল সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরিবেশ ও জনগোষ্ঠির বংশাণুসমষ্টির সহ বিবর্তনের (Gene-Culture Coevolution) ফল। এ প্রসংগে স্টিভেন পিঙ্কারের ""The Blank Slate'' এর ৬৯ পৃষ্ঠা থেক কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ ‘‘ইতিহাস ও সন্স্কৃতির ভিত্তি হতে পারে মনোবিজ্ঞান, যার ভিত্তি হতে পারে কলনবিজ্ঞান (Computation), স্নায়ুবিজ্ঞান,বংশাণুবিদ্যা ও বিবর্তনবিজ্ঞান। মানুষ তথা তাবৎ প্রাণীর সকল অংগই বিবর্তনের দ্বারা সৃষ্ট। মস্তিস্ক, যা কিনা সবচাইতে জটিল অংগ, তাও অবশ্যই বিবর্তনজাত। যেহেতু আচরন বা স্বভাব মস্তিস্কের সাথে সংযুক্ত, মানব স্বভাব তাই চূড়ান্ত বিচারে বিবর্তন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার বিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় বংশাণুর সঞ্চালন ও সংরক্ষণের জৈবিক তাড়নায়, পরিব্যক্তি আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। তাহলে দেখা যাছে যে উপর থেকে নীচু স্তর পর্যন্ত কার্যকারণের একটা পূর্বাপর সম্পর্ক বিদ্যমান’’ পিঙ্কারের উপরের উক্তির সাথে আমি একটা মন্তব্য জুড়ে দিতে চাই সেটা হল, যে বংশাণুর সঞ্চালন ও সংরক্ষণের জৈবিক তাড়না আবার পদার্ত্থবিজ্ঞানের বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষের স্বভাব সহজাত নয় এটা শেখান, পরিবেশ নির্ণয়বাদীদের এই উক্তিতে যে অসংগতি আছে সেটার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। স্টিভেন পিঙ্কার ""The Blank Slate'' এর ৪৪ পাতায় এ প্রসঙ্গে বলেন ‘‘বুদ্ধিমত্তা, বৈজ্ঞানিক মেধা,যৌন প্রবণতা ও সহিংসতার প্রতি আসক্তি ইত্যাদি কখনই পুরোপুরি শেখান নয়।’’ ৫১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘‘øায়ুবিজ্ঞান ও বংশাণুবিদ্যা এই সত্যটিই তুলে ধরে যে একটি অন্ধকারাছন্ন হূদয়ের দায় বাবা মা বা সমাজের উপর সবসময় বর্তান যায় না। যদি শেখানর দ্বারা মানুষের স্বভাবকে প্রভাবিত করা যেত তাহলে মনোবিকারগ্রস্তদের (Psychopaths) নিরাময় করা যেত। কিন্তু পিঙ্কার যেমনটি বলেন ২৬৩ পৃষ্ঠায় ‘‘মনোবিকারগ্রস্তদের নিরাময় করা যায় না’’ শেখানর মাধ্যমে যে মানুষের কুস্বভাব পরিবর্তন করা যায়না সেই সত্যটির সমর্থন মেলে একটি বাস্তব ঘটনায় । ঘটনাটির উল্লেখ আছে পিঙ্কারের বইতেই, ২৬২ পৃষ্ঠায়। ঘটনাটি হল নর্মান মেইলার নামক পুলিতজার পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন লেখক জ্যাক এবট্ নামক এক বন্দীকে মুক্ত করতে সাহায্য করেন কারণ তাঁকে লেখা এবটের চিঠিগুলো পড়ে তিনি খুবই চমৎকৃত হয়েছিলেন, আর ঐ চিঠিগুলি তিনি তাঁর ১৯৮০ সালে লিখিত বই "In the belly of the beast" তেও ছাপিয়েছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর এবট্ বেশ নামীদামী মহলে আপ্যায়িত হত, অনেক নৈশভোজেও আমন্ত্রিত হত। অথচ মাত্র দু সপ্তাহ পরে সে এক রেস্তোরার বেয়ারাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে রেস্তোরার টয়লেট ব্যবহার নিয়ে কথাকাটাকাটির সময়! পরিবেশ বা সংস্কৃতি নির্ণয়বাদীরা এই একটা যুক্তি প্রায়ই দেন যে যৌন অপরাধীরা নিজেরাও অতীতে যৌন অপরাধের শিকার হয়েছিল বলে যৌন অপরাধে লিপ্ত হয়। এটাও সবসময় সত্য নয়। জোন রজার্স (Joan Allen Rodgers) তাঁর ""Sex: A Natural History"" বইটিতে লিখেছেন যে বেশীর ভাগ শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের নিজেদের জীবনে শিশু নিপীড়নের কোন ইতিহাস নেই বলেই প্রমাণ মেলে। বইটির ৪২৯ পৃষ্ঠায় তিনি বংশাণুবিজ্ঞানী ফ্রেড বার্লিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে যে বিকৃত যৌন আচরণ শেখান নয়, এটা জৈবিকভাবেই অঙ্কুরিত। অবশ্য তিনি এটাও বলতে ভুলেননি যে সমাজ যেন ঐ ধরণের অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দেয় সমাজকে রক্ষা করার জন্যেই, কিন্তু একই সাথে ঐ আচরণকে বোঝার চেষ্টাও চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত না হয়ার আহ্বান জানান। পিঙ্কার তাঁর বইয়ের ৩১১ পৃষ্ঠায় বলেন যে কানাডীয়রা আমেরিকানদের মত একই টিভি শো দেখে কিন্তু কানাডায় অপরাধজনিত হত্যার হার আমেরিকার ১/৪ ভাগ মাত্র। এটা এই মতকেই নাকচ করে যে সহিংস আচরণ টিভি শো থেকে শেখা। পিঙ্কার আর একটা সাধারণ ধারণাকে প্রশ্ন করেন যেটা হল শিশুরা বেড়ে উঠার সময় বাহিরের প্ররোচণায় সহিংস আচরণ শেখে। তিনি ৩১৬ পৃষ্ঠায় এই যুক্তি দেন যে শিশুরা যূদ্ধ বা সহিংস খেলনার সাথে পরিচিত হবার অনেক আগেই সহিংস প্রবণতার লক্ষণ দেখায়। অন্যান্য অনেক ঘটনাও এই সাক্ষরই দেয় যে মানুষের স্বভাব শেখার দ্বারা সৃষ্ট নয়। আমরা দেখি কিভাবে কোন কোন মানুষ ধার্মিক হয়ে যায় ধর্মশিক্ষা বা প্রচারণার অবর্তমানেই। আবার উলটোটাও দেখা যায়। হঠাৎ করেই ধর্মভীরু বা ধর্মান্ধ ব্যক্তি নাস্তিক বনে যায়। একটা নিষ্ঠুর সত্য অনেক বাবা মাকেই মেনে নিতে হয় যে তাঁদের ছেলেমেয়েকে যতই শেখান হোক না কেন তারা সবসময় তাঁদের মনমত হয়ে তৈরী হয়না । যে শেখাটা তাদের বংসশাণবিক প্রবণতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সেগুলিই তারা সহজে গ্রহণ বা আত্মীকরণ করে। যার বংসশাণবিক প্রবণতা শিল্পকলার প্রতি তাকে জোর করে চিকিৎসাবিদ্যা বা প্রকৌশলবিজ্ঞান শেখানর চেষ্টা ফলপ্রসূ না হবার সম্ভাবনাই বেশী। এখন আসি কেন এখনও অনেকের মধ্যে এই স্বছ স্লেটের ধারণা বা চরম পরিবেশ নির্ণয়বাদের প্রতি আসক্তি দেখা যায় যদিও স্পষ্টত তা বিজ্ঞানের প্রমাণ ও সাক্ষ্যের পরিপন্থী সেই আলোচনায়। একটা কারণ হল তারা ভয় করেন যদি আচরণ বংশাণুনিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ জন্মগতই হয় এটা স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলে মানুষের কুকর্মের কোন জবাবদিহিত্ব থাকলনা। জন্মগত স্বভাবের দরুন কোন আচরণের জন্য মানুষকে দায়ী করা যাবে না,কারণ জন্মগত বৈশিষ্ট্যের উপর মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু এই চিন্তার একটা ত্রুটি হল যে একই কথা বলা যায় পরিবেশ নির্ণয়বাদের ক্ষেত্রেও। পরিবেশ ও তো ব্যক্তিবিশেষের আওতার বাইরে। পরিবেশ তৈরী হয় অনেক মানুষের সমন্নয়ে অনেক সময় ধরে। পরিবেশ নির্ণয়বাদীরা স্বাধীন ইচ্ছাকে পরিবেশের সাথে যুক্ত করেন। কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা দিয়ে পরিবেশকে তো বদলান যায়না। আসলে যেটা তাঁরা ভুলে যান সেটা হল, পরিবেশ বা জন্ম যে কারণেই হোক অপরাধের শাস্তি বিধান ও জবাবদিহিত্ব থাকবেই সমাজকে রক্ষার জন্য, বিবর্তনের তাগিদেই। কাজেই তাদের এই ভয় অমূলক। দ্বিতীয়ত, তাদের ভয় যে বংশাণবিক নিয়ন্ত্রণের সত্য স্বীকার করলে মানুষের মধ্যে অসাম্যকে মেনে নিতে হবে কারণ মানুষের বৈশিষ্ট্যের (মেধা, বল ইত্যাদি) উপর বংশাণূর প্রভাব সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। এর ফলে সাম্যবাদ প্রচারে সমস্যা হতে পারে। কারণ সাম্যবাদের মূল স্বীকার্য্য হল সব মানুষই জন্মগতভাবে সমান। এই কারণেই মার্ক্স্ বংশাণুবিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু মানুষে মানুষে সাম্য তাদের জন্মগত অভিন্নতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত করা ঝুঁকিপূর্ণ। বস্তুতঃ সাম্যতা বাহ্যিক কোন শর্তভিত্তিক হয়া উচিত নয়। এটাকে একটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই গ্রহণ করা বা®ণীয়। কারণ বাহ্যিক শর্তগুলি পরিবর্তনশীল ও বিতর্কিত হতে পারে। যে কোন মতবাদ, সেটা সাম্যবাদই হোক বা অন্য কোন মতবাদই হোক তার মেধা নিজের গুনেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করা উচিত, অন্য কোন শর্তের উপর ভিত্তি করে নয়। বস্তুতঃ সব মানুষই জন্মগত ভাবে অভিন্ন না বলে বলা উচিত সব মানুষই জন্মগতভাবে সমান মানবাধিকারের অধিকারী। কিন্তু জন্মগতভাবে তাদের সব বৈশিষ্ট্যই সমান বা অভিন্ন এটা বলা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল।