যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি - অপার্থিব ভূমিকাঃ সবাই কমবেশী বিতর্কে অংশ নেন। নানারকম যুক্তি দিয়ে নিজের সিধ্বান্তঅপর পক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যুক্তিগুলো অভ্রান্ত কিনা কজন তা নিয়ে মাথা ঘামান? যুক্তির কিছু নিয়ম কানুন আছে সেটা সবাই মানেন। কিন্তুনিয়মগুলি কি তা কজন জানেন আর কজন ই বা তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করেন? অনেকে ভুল যুক্তির দ্বারা নিজের সিধ্বান্ত প্রমাণ বা অপরের সিধ্বান্তখন্ডন করে আত্মশ্লাঘার অধ্যাস (Illusion) বোধ করেন। কুযুক্তির দ্বারালব্ধ আত্মশ্লাঘা কু-অর্জিত এবং সেই আত্মশ্লাঘা আত্ম প্রবঞ্চণার বা নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানর সামিল । আর সঠিক যুক্তির দ্বারা লব্ধ আত্মতৃপ্তি সু-অর্জিত আর তার দ্বারা লব্ধ সিদ্ধান্ত অপর পক্ষ মুখে না মানলেও মনে মনে অন্তত মেনে নেবেন, অধিকাংশ বিপক্ষের ক্ষেত্রেই এ কথা বলা যায়,কেবল মাত্র বদ্ধচিন্তার অধিকারীরা, যারা সঠিক যুক্তির ধার ধারেন না, তারাছাড়া। তবে এটা আশা করা যায় যে বিতর্কে অংশগ্রহণ কারীদের অধিকাংশ সঠিক যুক্তিতে আগ্রহী। যুক্তিশাস্ত্রে কুযুক্তিকে হেত্বাভাস বা হেতুদোষ(Fallacy) বা সোজা ভাষায় যুক্তিভ্রম বলা হয়। হেত্বাভাস যুক্তির মূলনীতি গুলীর ভংগন বা ভুল প্রয়োগের কারণেই সৃষ্ট হয়। হেতুদোষ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কে সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত হয়।হেত্বাভাস এড়ান ও যুক্তির মধ্যে হেত্বাভাসের উপস্থিতি নির্ণায়ন যুক্তিশাস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। যাঁরা নিজেদের যুক্তিবাদী বলে দাবী করেন তাঁদের জন্য যুক্তির মৌলিক নিয়ম কানুন জানা আবশ্যকীয়।তাহলে এবার আসা যাক যুক্তিশাস্ত্রের মূল ধারণা আর নিয়ম কানুনগুলির আলোচনায়। যুক্তিরু সংজ্ঞাবলীঃ বাক্য থেকেই শুরু করা যাক। বাক্য দুপ্রকার :- (১) অবধারণযোগ্য (Cognitive) (২)অনবধারণযোগ্য (Non- Cognitive)। যে বাক্যে এমন কোনো শব্দ আছে যার কোনো বস্তুগত বা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ (Objective) ে বা সার্বজনীন (সর্বসম্মত) এবং স্ববিরোধিতামুক্ত সংজ্ঞা বা অর্থ নেই, অথবা যে বাক্যের ব্যাকরণগত কোনো অর্থ নেই সেই বাক্যকে অনবধারণযোগ্য বাক্য বলা হয়, আর তা না হলে অবধারণযোগ্য বলা হয়। উদাহরণ দিয়ে বোঝান যাকঃ (১) ’বাঘ মাংসভোজী জীব’, ‘গোলাপ ফুল সুন্দর’, ’পক্ষীরাজ ঘোড়া আছে’ প্রত্যেকটি হল অবধারণযোগ্য বাক্য। গোলাপ ফুল যদিও সবার কাছে সুন্দর নাও মনে হতে পারে (বাক্যের সত্যতা/মিথ্যাত্ব (অন)অবধারণযোগ্যতা নির্ধারণে অবান্তর), কিন্তু ’গোলাপ’, ’ফুল’, ’সুন্দর’ প্রত্যেক শব্দই হয় বস্তুগত নয় সার্বজনীন। সৌন্দর্যের অনুভুতি/ধারণা সার্বজনীন। তবে সৌন্দর্য আরোপনের লক্ষ্যবস্তু সার্বজনীন নাও হতে পারে। পক্ষীরাজ ঘোড়া খুব সম্ভবত নেই। কিন্তু পক্ষীরাজ ঘোড়ার বস্তুগত সংজ্ঞা আছেঃ পক্ষ যুক্ত ঘোড়া যা উড়তে পারে। কাজেই বাস্তবে পক্ষীরাজ ঘোড়ার অস্ত্বিত্ব না থাকলেও এর ধারণাটি বস্তুগত, এর অস্তিত্ব কল্পনা করা মোটেই কষ্টকর নয় এবং এর কল্পনা সবার জন্য একই, ব্যক্তি-নির্ভর নয়। (২) ’ইশ্বর আছেন’ , এই বাক্যটি অনবধারণযোগ্য, কারণ ‘ইশ্বর’ এর কোনো বস্তুগত বা সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। এক এক ধর্মে একেক সংজ্ঞা, আবার প্রত্যেক সংজ্ঞাগুলিতে সূক্ষ বিশ্লেষণে বিরোধিতাও প্রতীয়মান হয়। ‘প্রতীয়মান এক ধর্মে আবার’ এই বাক্যটিও অনবধারণযোগ্য। এই বাক্যের প্রত্যেকটি শব্দই যদিও সুসংজ্ঞিত (Well-Defined), তবুও অর্থহীন হবার দরুন একে অনবধারণযোগ্য বাক্য হিসেবেই শ্রেণীভুক্ত করতে হবে। অবধারণযোগ্য বাক্যকে আবার দুভাগে বিভক্ত করা যায় যথাঃ (১) বচনবাক্য (Proposition) এবং (২) অবাচনিক বাক্য (Non-Proposition)।যে বাক্যে সুস্পষ্ট, বস্তুগত সত্য বা মিথ্যা গুন (Truth/Falsehood) আছে তাকে বচন বলে। অর্থাৎ বাক্যটি হয় সত্য নয় মিথ্যা, এব্যাপারে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। যেমন ‘পৃথিবীটা গোল‘, এই বাক্যটি একটি বচন,কারণ এই বাক্যটি হয় সত্যি, নয় মিথ্যা, এর সত্যতা/মিথ্যাত্ব ব্যক্তি-নির্ভরনিয়। ’এই খাবারটি খুব সুস্বাদু’, এই বাক্যটি বচন নয়, কারণ, স্বাদ ব্যক্তি-নির্ভর, বস্তুগত নয়। একই খাবার কারো কাছে সুস্বাদু মনে হতে পারে,আবার কারো কাছে বিস্বাদময়। যুক্তিতে বচনহীন বাক্য ব্যবহার করা অবান্তর, অবাঞ্ছনীয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হেতুদোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বচন বাক্য নিয়েই যুক্তিশাস্ত্রের মনোযোগ নিবেদিত। এখন থেকে বচন বাক্যকে আমরা ’ক’, ’খ’ ইত্যাদি সংকেত চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করব।এখানে উল্লেখ্য যে দুই বা ততোধিক সরল বাক্য যুক্ত করে যেমন যৌগিক বাক্য গঠিত হয়, তেমনি দুই বা ততোধিক সরল বচন যুক্ত করে যৌগিক বচনও গঠিত হতে পারে। এর উদাহরণ নীচেই পাওয়া যাবে। বচনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়ঃ (১) শর্তনিরপেক্ষ (Categorical) (২) শর্তাপেক্ষ বা প্রাকল্পিক (Hypothetical), এবং (৩) বৈকল্পিক (Disjunctive) উদাহরণঃ (১) কাক হয় কাল (২) তাপ দিলে বরফ গলে (যদি বরফে তাপ দেয়া হয় তাহলে বরফ গলে) (৩) করিম হয় বাসায় আছে না হয় অফিসে। এখানে উল্লেখ্য যে (২) এবং (৩) যৌগিক বচনের উদাহরণ। (২) এ বলা হচ্ছে যে যদি ’বরফে তাপ দেয়া হল’ বচনটি সত্য হয় তাহলে ‘বরফ গলল‘ বচনটিও সত্য হবে। (৩) এ বলা হছে যে ’করিম বাসায় আছে’ এবং ’করিম অফিসে আছে’ এই দুই বচনের মধ্যে একটি সত্য। কোনটি সত্য সেটা অবশ্য বলা হছে না। সংকেতের সাহায্যে এই তিনটি বচনের রূপকে এভাবে ব্যক্ত করা যায়ঃ (১) ক , (২) যদি ক, তবে খ, (৩) হয় ক, না হয় খ বচনের দুইটি অংশ বা পদ, যথা উদ্দেশ্য (Subject)ও বিধেয়(Predicate)বচনে যে বস্তু/ব্যক্তি ইত্যাদির সাথে কোন গুণ বা কাজকে সংযুক্ত করা হয় তাকে উদ্দেশ্য বলে, আর উদ্দেশ্যের সাথে সংযুক্ত গুণ বা কাজকে বিধেয় বলা হয়। আমরা উদ্দেশ্য ও বিধেয় পদকে যথাক্রমে ’স’ এবং ’প’দ্বারা চিহ্নিত করব। শর্তনিরপেক্ষ বচন চার রকমের হয়ঃ (১) সার্বিক সদর্থক (A) (২) সার্বিক নঞর্থক (E) (৩) বিশেষ সদর্থক (I) (৪) বিশেষ নঞর্থক (O) ঐতিহাসিক কারণেই উপোরক্ত চার রকম বচনকে পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞানে যথাক্রমে A,E,I এবং O দ্বারা নির্দেশিত হয়। আমরাও পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞানের অনুকরণে ঐ চারটি সংকেত ব্যবহার করব। এখন উদাহরণ দ্বারা এই চা রকম শর্তনিরপেক্ষ বচনের সজ্ঞার্থ দেয়া যাকঃ A: সকল কাক হয় কাল ( সকল ’স’ হয় ’প’)। E: কোন কাকই সাদা নয় ( কোন ’স‘ নয় ’প’) I: কোন কোন বিড়াল হয় কাল (কোন ‘স’ হয় ’প‘)। O: কোন কোন বিড়াল কাল নয় (কোন ’স‘ হয় না ’প‘)। ব্যাপ্য পদ (Distributed Term): শর্তনিরপেক্ষ বচনের উদ্দেশ্য বা বিধেয়পদ যদি কোন সমষ্টি বা গোষ্ঠির (Set) এর প্রত্যেক সদস্যকেই নির্দেশ করে তাহলে সেই পদকে ব্যাপ্য পদ বলা হবে। নতুবা তাকে অব্যাপ্য পদ বলা হবে। উদাহরণ দিয়ে বোঝালে ব্যাপারটা সহজ হবেঃ উপরের ‘‘সকল কাক হয় কাল’’ A বচনে উদ্দেশ্য(কাক) হল ব্যাপ্য পদ, কারণ এখানে কাক গোষ্ঠির সব সদস্যকেই নির্দেশ করা হছে, কিন্তু বিধেয় (কালো) অব্যাপ্য পদ, কেননা এখানে কাল রং সম্পন্ন সকল প্রাণী বা বস্তুর গোষ্ঠি সম্পর্কে নির্দেশ করা হছে না, কেবল মাত্র কাক সম্পর্কে। কাল রং কাক ছাড়া অন্য অনেক প্রাণী ও বস্তুকেও অন্তর্ভুক্ত করে। উপরের E বচনে উদ্দেশ্য ও বিধেয় উভয়ই ব্যাপ্য, কারণ কাক গোষ্ঠির সকল সদস্যকেই নির্দেশ করে বলা হছে যে কোন কাকই সাদা নয়, আবার সাদা রঙ্গের সকল প্রাণী বা বস্তুকে নির্দেশ করে বলা হছে যে এদের কেউই কাক নহে। উপরের I বচনে উদ্দেশ্য ও বিধেয় উভয়ই অব্যাপ্য, কারণ বিড়াল গোষ্ঠির সকল সদস্য বা সম্পর্কে কিছু বলা হছে না এবং কাল রং সম্পন্ন সকল প্রাণী বা বস্তুর গোষ্ঠি সম্পর্কেও কিছু বলা হছে না। সবশেষে O বচনে উদ্দেশ্য অব্যাপ্য, বিধেয় ব্যাপ্য। আশ্রয়বাক্য (Premise): কোন বচনকে সত্য ধরে নিয়ে তার সাহায্যে যুক্তির সূত্র প্রয়োগ করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হলে সেই বচনকে আশ্রয়বাক্য বলা হবে। বলাই বাহুল্য যে কোন যথাযথ বিতর্কের গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তির জন্য সকল আশ্রয়বাক্যই সর্বজন স্বীকৃত বা গৃহীত হতে হবে। ন্যায় (Syllogism): ন্যায় হল তিন বচনের সমষ্টি, যেখানে প্রথম দুই বচনকে আশ্রয়বাক্য হিসাবে গ্রহ্নণ করে যুক্তির সূত্র প্রয়োগ করে তৃতীয় বচন সিদ্ধান্ত হিসাবে ঘোষিত হয়। তাহলে যে কোন ন্যায়ের আকারের সাংকেতিক রূপ হবেঃ ক (প্রথম আশ্রয়বাক্য) খ (দ্বিতীয় আশ্রয়বাক্য) -- অতএব গ (সিধ্বান্ত) সাধ্য পদ বা প্রধান পদ (Major Term): ন্যায়ের সিদ্ধান্তের বিধেয়কে সাধ্য পদ বা প্রধান পদ বলা হয়। পক্ষ পদ বা অপ্রধান পদ (Minor Term): ন্যায়ের সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্যপদকে পক্ষ পদ বা অপ্রধান পদ বলা হয়। মাধ্যম পদ বা হেতু পদ (Middle Term): ন্যায়ের দুই আশ্রয়বাক্যের মধ্যে সাধারণ (Common) যে পদ সেই পদকে মাধ্যম পদ বা হেতু পদ বলা হয়। আমরা সাধ্য পদকে ‘‘স’’, পক্ষ পদকে ‘‘প’’ আর মাধ্যম পদকে ‘‘ম’’ দিয়েনির্দেশ করব পরবর্তীতে। প্রধান আশ্রয়বাক্য (Major Premise): যে আশ্রয়বাক্যে প্রধান পদ আছে সেই আশ্রয়বাক্যকে প্রধান আশ্রয়বাক্য বলা হয়। অপ্রধান আশ্রয়বাক্য (Minor Premise): যে আশ্রয়বাক্যে অপ্রধান পদ থাকে সেই আশ্রয়বাক্যকে অপ্রধান আশ্রয়বাক্য বলা হয়। আবারও একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝান যাক সংজ্ঞাগুলিকেঃ কঃ সকল অধ্যাপক হন শিক্ষিত। খঃ কোন কোন বাঙ্গালী হন অধ্যাপক। গঃ অতএব কোন কোন বাঙ্গালী হন শিক্ষিত। এখানে সাধ্য পদ(‘‘স’’) = শিক্ষিত, পক্ষ পদ(‘‘প’’) = বাঙ্গালী এবং মাধ্যমপদ(‘‘ম’’) =অধ্যাপক ’ তাহলে সাংকেতিক ভাবে উপরের ন্যায়কে ব্যক্ত করা যায় এভাবেঃ ম - স (বচনের প্রকারঃ A) প - ম (বচনের প্রকারঃ I) --- অতএব প - স (বচনের প্রকারঃ I) ন্যায়ের রূপ (Mood) ও সংস্থান (Figure): ন্যায় যেহেতু তিনটি বচন দ্বারা গঠিত (দুটি আশ্রয়বাক্য ও একতি সিধ্বান্ত) আর যে কোন বচন A,E,I,O এই চার প্রকার হতে পারে সেহেতু ন্যায় এই চারটি থেকে যে কোন তিনটি দিয়ে যে কোন ক্রমে গঠিত হতে পারে, যেমন AAA, AEA, ...EIO..., ..., (৬৪ টি সম্ভাব্য প্রকার) ইত্যাদি। এগুলিকে ন্যায়ের রূপ বা মূর্তি বলা হয়। উপরের উদাহরণের রূপ হল AII আবার দুই আশ্রয়বাক্য ও সিদ্ধান্তের সাধ্যপদ, পক্ষপদ ও মাধ্যম পদকে যেহেতু চার ভাবে সাজান যায় সেহেতু ন্যায়ের চার রকম সংস্থান হতে পারে যেমনঃ সংস্থান-১: সংস্থান-২ সংস্থান-৩ সংস্থান-৪ ম - স স - ম ম - স স - ম প- ম প - ম ম - প ম - প --- --- --- --- অতএব প - স অতএব প - স অতএব প - স অতএব প - স প্রত্যেকটি সংস্থানের যেহেতু ৬৪ টি রূপ বা মূর্তি হতে পারে সেহেতু ন্যায়ের মোট ২৫৬ টি প্রকার হতে পারে। কিন্তু এর সবগুলই বৈধ নায়্য নয়। যুক্তির সূত্রাবলী ২৫৬ কে কাটছাট করে কেবল ১৫ টি বৈধ ন্যায়ে নামিয়ে আনে। এই ১৫ টি বৈধ ন্যায়ের রূপ গুলি হলঃ AAA-১, EAE-১, AII-১, EAO-১, EAE-২, AEE-২, EIO-২, AOO-২, IAI-৩, AII-৩, OAO-৩, EIO-৩, AEE-৪, IAI-৪, EIO-৪ এখানে -১, -২, -৩, -৪ দ্বারা সংস্থান বোঝান হয়েছে। এবার তাহলে যুক্তির সূত্রাবলী নিয়েই আলোচনায় নামি। যুক্তির বিধিসমূহঃ আগেই উল্লাখ করেছি যে সব ন্যায়েই বৈধ নয়। যুক্তির বিধি গুলি ন্যায়ের অনেক রূপকেই অবৈধ করে দেয়। ন্যায়ের এই বিধি গুলি চিন্তার কতকগুলি মূল সূত্রের উপরে ভিত্তি করে লব্ধ। চিন্তার এই মূল সূত্রগুলি অতি সহজেই স্বতঃপ্রতীয়মান সত্য বচন (Self-Evident) মনে হতে পারে, কিন্তু এই সরল বচনগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এগুলিকে যুক্ত করে বা পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করে জটিল সত্য বচন গঠন করা যায়, যার সত্যতা স্বতঃপ্রতীয়মান নাও মনে হতে পারে। বা বিকল্পে এটাও বলা যায় যে কোন জটিল বচন বাক্য যে মিথ্যা তা জটিল বাক্যট দেখে বোঝা না গেলেও জটিল বাক্যটিকে ভেঙ্গে বা বিশ্লেষণ করে যদি দেখা যায় যে কোন মূল সূত্র লংঘিত হয়েছে, তাহলে জটিল বাক্যটি যে মিথ্যা সেই সিধ্বান্ত নেয়া যায়। চিন্তার এই সরল মূলসূত্রগুলিকে তাই যুক্তির আণবিক উপাদান বলা যায়। চিন্তার মূল সূত্রগুলি হলঃ (১) তাদাত্ম্য বা অভিন্নতার সূত্র (Identity Law) : ক = ক এখানে ‘‘ক’’ কোন বস্তু বা ব্যক্তির গুণ (Attribute) বোঝাছে। উদাহরণঃ কালো = কালো ইত্যাদি। (২) বিরোধাত্মক সূত্র (Law of Contradiction) ‘‘ক=খ’’ এবং ‘‘ক= নয় খ’’ একই সাথে সত্য হতে পারেনা। যেমন বিড়ালটি কালো আর বিড়ালটি কালো নয় একই সাথে সত্য হতে পারেনা (৩) নির্মাধ্যম সূত্র (Law of Excluded Middle): যদি ‘‘খ’’ ‘‘ক’’এর কোন সম্ভাব্য/গ্রহ্নণীয় গুণ হয় তাহলে ‘‘ক=খ’’ এবং ‘‘ক=নয় খ’ এই দুটির একটিকে সত্য হতেই হবে। বিড়ালটি কালো অথবা কালো নয়। দ্রঃ (২) এর হাথে এর সূক্ষ পার্থক্য লক্ষ্য করুন, (২) কেবল বলে যে এই দুটি একসাথে সত্য হতে পারেনা। অধিকাংশ বিতর্কের যুক্তি এবং সিধান্ত গুলি হয় জটিল বাক্য, এবং চট করে ঐ জটিল বাক্যগুলিকে ভেঙ্গে বা বিশ্লেষণ করে উপরোক্ত কোন সূত্র লংঘিত হওয়ার ভিত্তিতে যুক্তিটির সত্যতা/মিথ্যাত্ম বিচার করা বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য তর্কবিজ্ঞানীরা এই সূত্রগুলিকে ভিত্তি করে কিছু উঁচু স্তরের ন্যায়ের (শর্তনিরপেক্ষ) বিধি বের করেছেন, যা প্রয়োগ করে জটিল যুক্তির সত্যতা বা মিথ্যাত্ম বিচার করা আপেক্ষিকভাবে সহজ। এখন এই বিধিগুলির আলোচনায় আসি। ন্যায়ের বিধিসমূহঃ বিধি-১: যে কোন ন্যায়ে কেবলমাত্র তিনটি পদ (পূর্বোক্ত ‘‘স’’, ‘‘প’’ ও ‘‘ম’’) থাকতে হবে এবং সাধ্য ও পক্ষ পদের অর্থ দুই আশ্রয়বাক্য এবং সিদ্ধান্তের মাঝে কোথাও পরিবর্তন করা যাবে না। এই বিধি লংঘিত হলে যে হেতুদোষের সৃষ্টি হয় তাকে বলে অনেকার্থক দোষ (Fallacy of Equivocation) । বাকচাতুরিতে এই হেতুদোষ প্রয়োগ করা হয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। বিধি-২ : যে কোন ন্যায়ে মাধ্যম বা হেতু পদটি দুই আশ্রয়বাক্যের মধ্যে অন্তত একটিতে ব্যাপ্য হতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে যে হেতুদোষের উদ্ভব হয় তাকে বলা হয় অব্যাপ্য হেতুদোষ (Fallacy of Undistributed Middle) । এটি একটি সাধারণ হেতুদোষ। একটি উদাহরণ দিয়ে এই হেত্বাভাস বোঝান যাকঃ কঃ সকল কুকুর হয় স্তন্যপায়ী খঃ সকল বিড়াল হয় স্তন্যপায়ী গঃ অতএব সকল বিড়াল হয় কুকুর এখানে মাধ্যম পদ (স্তন্যপায়ী) কোন আশ্রয়বাক্যেই ব্যাপ্য হয় নি, কারণ সকল স্তন্যপায়ী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয় নি। বিধি-৩: শর্তনিরপেক্ষ ন্যায়ের সিধ্ব্বান্েতর কোন পদ (সাধ্য বা পক্ষ) কোন আশ্রয়বাক্যে অব্যাপ্য হলে সিদ্ধান্ত ব্যাপ্য হতে পারে না। সাধ্যের ক্ষেত্রে এই বিধি লংঘিত হলে যে হেতুদোষের উদ্ভব হয় তাকে বলে অবৈধ সাধ্য দোষ (Fallacy of Illicit Major), আর পক্ষের ক্ষেত্রে এই দোষ ঘটলে তাকে বলা হয় অবৈধ পক্ষ দোষ (Fallacy of Illicit Minor)। উদাহরণের দ্বারা এই দুই হেতু দোষের ব্যাখ্যা দেয়া যাকঃ অবৈধ সাধ্য দোষঃ কঃ সকল কুকুর হয় স্তন্যপায়ী প্রাণী। খঃ কোন বিড়াল নয় কুকুর। গঃ অতএব কোন বিড়াল নয় স্তন্যপায়ী প্রাণী। (এখানে সাধ্যপদ স্তন্যপায়ী সিদ্ধান্তে ব্যাপ্য কিন্তু প্রথম আশ্রয়বাক্যে অব্যাপ্য) এখানে এটা বিশেষ জোর দিয়ে বলা দরকার যে উপরের ন্যায়টি অবেধ এই কারণে নয় যে সিধ্ব্বান্তটি আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মিথ্যা বলে জানি। সিদ্ধান্তের সত্যতা/মিথ্যাত্ব যাচাই করে ন্যায়েয় বৈধতা কখনও নির্ধারিত হয় না। অবৈধ সাধ্য দোষ যুক্ত ন্যায়ের সিদ্ধান্ত সত্যও হতে পারে। আরেকটা উদাহরণ দিয়ে এটা বোঝান যাকঃ কঃ সকল সাপই সরীসৃপ খঃ কোন কোন সাপ বিপজ্জনক জন্তু নয়। গঃ অতএব কোন কোন বিপজ্জনক জন্তু নয় সরীসৃপ । ন্যায়ের বিধিগুলি এমন ভাবে ব্যক্ত যাতে এর ভিত্তিতে গঠিত যুক্তি কখনই চিন্তার মূল সূত্রগুলিকে লংঘন না করে। বিশেষ ক্ষেত্রে অবৈধ ন্যায়ের সিদ্ধান্ত সত্য হলেও সেই ন্যায় বৈধ হয় না। অবৈধ পক্ষ দোষঃ কঃ সব ককেশীয়রা শ্বেতাঙ্গ। খঃ কোন আমেরিকান ককেশীয়। গঃ অতএব সকল আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ। (এখানে পক্ষপদ আমেরিকান সিদ্ধান্তে ব্যাপ্য কিন্তু দ্বিতীয় আশ্রয়বাক্যে অব্যাপ্য) বিধি-৪: উভয় আশ্রয়বাক্য একই সাথে নঙর্থক হতে পারে না। এই বিধির ব্যত্যয় ঘটলে নঙর্থক আশ্রয়বাক্য জনিত দোষ (Fallacy of Negative Premises) এর সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ ‘‘কোন মা ই পুরুষ নয়’’ এবং ‘‘কোন নিঃসন্তানই মা নয়’’ এই দুইটি আশ্রয়বাক্য দ্বারা ‘‘নিঃসন্তান’’ এবং ‘‘পুরুষ’’ এই দুইয়ের মধ্যে নিশ্চিত ভাবে কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সিধ্বান্ত ঘোষণ করা যায়না পরবর্তী বিধিগুলি পূর্ববর্তী চার বিধি হতেই লব্ধঃ বিধি-৫: ন্যায়ের কোন আশ্রয়বাক্য নঙর্থক হলে সিদ্ধান্তও নঙর্থক হতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে যে হেতুদোষের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় নঙর্থক আশ্রয়বাক্য থেকে সদর্থক সিধ্বান্ত দোষ (Fallacy of Drawing Affirmative Conclusion from Negative Premise) । বিধি-৬: ন্যায়ের উভয় আশ্রয়বাক্য সদর্থক হলে সিদ্ধান্তকেও সদর্থক হতে হবে। বিধি-৭: ন্যায়ের অন্তত একটি আশ্রয়বাক্য সামান্য বা সার্বিক (Universal) অর্থাৎ A বা E প্রকারের হতে হবে। বিধি-৮: ন্যায়ের কোন আশ্রয়বাক্য বিশেষ বচন (অর্থাৎ I বা O) হলে সিদ্ধান্তকেও বিশেষ বচন হতে হবে। বিধি-৯: ন্যায়ে সাধ্য আশ্রয়বাক্য বিশেষ বচন আর পক্ষ আশ্রয়বাক্য নঙর্থক, এমনটি হতে পারেনা। বিধি-১০: যে ন্যায়ের উভয় আশ্রয়বাক্য সামান্য (সার্বিক) তার সিদ্ধান্ত কখনও বিশেষ হতে পারে না। প্রাকল্পিক ও বৈকল্পিক ন্যায়ঃ পূর্বোক্ত বিধিগুলির দরুন শর্তনিরপেক্ষ ন্যায়ের ২৫৬ টি সম্ভাব্য মূর্তি কমে ১৫টি বৈধ মূর্তিতে নেমে আসে এটা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রাকল্পিক বা বৈকল্পিক আশ্রয়বাক্য যুক্ত ন্যায়ের চারটি বৈধ আকার হতে পারেঃ(এখানে ‘‘ক -> খ’’ দ্বারা ‘‘যদি ক হয় তাহলে খ হয়’’বোঝান হয়েছে) (১) সদর্থক বা স্বীকৃতিমূলক (Modus Ponens): ক -> খ । উদাহরণঃ ক । যদি গতকাল রোববার ছিল তাহলে আজ সোমবার - । গতকাল রোববার ছিল অতএব খ । অতএব আজ সোমবার এই ন্যায়টির একটি ভুল ব্যক্তরূপ হলঃ ক -> খ । উদাহরণঃ যদি আজ ঈদ, তাহলে আজ অফিস ছুটি খ । আজ অফিস ছুটি অতএব ক । অতএব আজ ঈদ এই ভুল ন্যায় জনিত হেতুদোষ তাকে অনুগস্বীকৃতির দোষ (Fallacy of Affirming the Consequent) বলে, উপরের উদাহরণ তার একটি নমুনা। (২) নিষেধাত্মক বা অস্বীকৃতিমূলক (Modus Tollens) : ক -> খ । যদি আজ ঈদ হয় তাহলে আজ অফিস ছুটি নয় খ । আজ অফিস ছুটি নয় অতএব নয় ক । অতএব আজ ঈদ নয় এই ন্যায়ের একটি ভুল রূপ হলঃ ক->খ । যদি আজ ঈদ হয় তাহলে আজ অফিস ছুটি নয় ক । আজ ঈদ নয় অতএব নয় খ । অতএব আজ ছুটি নয় এই হেতুদোষকে পূর্বগ অস্বীকৃতির দোষ (Fallacy of Denying theAntecedent) বলা হয়। উপরের উদাহরণে আজ ঈদ না হলেও শুক্রবার হয়ার জন্য অফিস ছুটি হতে পারে। (আবার স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিৎ যে সিদ্ধান্ত মিথ্যা হয়ার জন্য ন্যয়ের রূপটি অবৈধ নয়, নিষেধাত্মক ন্যায়ের বৈধ রূপ অনুসরণ না করাই এর অবৈধতার কারণ)। (৩) প্রাকল্পিক ন্যায় (Hypothetical Syllogism): ক->খ । যদি রাম মেলায় যায় তাহলে যদু মেলায় যায় খ->গ । যদি যদু মেলায় যায় তাহলে শ্যাম মেলায় যায় অতএব ক->গ । অতএব যদি রাম মেলায় যায় তাহলে শ্যাম মেলায় যায় (৪) বৈকল্পিক ন্যায় (Disjunctive Syllogism): হয় ক নয় খ নয় ক (বা নয় খ) অতএব খ (বা ক) শর্তনিরপেক্ষ ন্যায়ের ১০ টি বৈধ রূপ, এবং প্রাকল্পিক ও বৈকল্পিক ন্যায়ের৪ টি, মোট এই ১৪ টি বৈধ রূপ অনুসরণ করে হেতুদোষ মুক্ত যুক্তির অবতারণা করা সম্ভব। তবে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে কোন কোন বিধি ছাড়া অন্যান্য বিধি গুলি সরাসরি প্রয়োগ করে সাধারণ বিতর্কের যুক্তিতে হেতু দোষ সনাক্ত করা সব সময় বাস্তবসম্মত নয়, কারণ বিতর্কের যুক্তিবাক্যগুলি সাধারণত জটিল আকারের। এ জন্য যুক্তিবিজ্ঞানিরা এই বিধিগুলি লংঘনের চূড়ান্ত পরিণামে যে সকল হেতুদোষের সৃষ্টি হতে পারে তার একটা তালিকা সংকলিত করেছেন। সংকলিত এই হেতুদোষগুলি পরামর্শ করে বিতর্কে ব্যবহ্রত যুক্তির দোষ আপেক্ষিকভাবে সহজে সনাক্ত করা যায়। এই সংকলিত হেতুদোষ গুলিকে চল্তি হেতুদোষ (Informal Fallacies) বলা হয়। এই হেতুদোষ গুলির উদাহরণসহ আলোচনা পরবর্তী লেখায় ব্যক্ত করার ইছা রইল।