Site hosted by Angelfire.com: Build your free website today!
যুক্তিবাদ কি? - অপার্থিব জামান যুক্তিবাদ(Rationalism) এক কথায় এমন একটি জীবনাদর্শ বা ব্যক্তিগত দর্শন যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেখানে প্রযোজ্য সেখানে যুক্তি এবং প্রমাণকেই (Logic and Evidence) প্রাধান্য দেয়া। যুক্তিবাদ কেবল যুক্তি, প্রমাণ ও সবিচার চিন্তার (Critical Thinking) দ্বারাই সত্যতা যাচাই ও বাস্তব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায় বলে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তিবাদের এক আবশ্যিক ফলশ্রুতি হল সংশয়বাদ (Skepticism), অর্থাৎ যুক্তি প্রমাণ ও সহায়ক উপাত্তের (Supporting data) অভাবে কোন কিছুর সত্য মিথ্যা যাচাইএর ব্যাপারে চূড়ান্ত বিচার বা সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকা। অনেকে যুক্তিবাদের সাথে মুক্তচিন্তাকে (Free Thinking) এর সাথে যুক্ত করেন । যুক্তিবাদ যদিও আবশ্যিকভাবে মুক্তচিন্তা বোঝায়, কিন্তু মুক্তচিন্তা সব ক্ষেত্রে যুক্তিবাদের সমার্থক নাও হতে পারে। মুক্তচিন্তার অর্থ হল বস্তুজগৎ বা জীবন সম্পর্কে কোন মতবাদ (Dogma) বা দৈব আদেশ বা ধর্মীয় বিধান কে আশ্রয় না করে স্বকীয় চিন্তার দ্বারাই অভিমত বা সিদ্ধান্ত নেয়া। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে যুক্তিবাদ আবশ্যিকভাবে মুক্তচিন্তা বোঝায়, যেখানে স্বকীয় চিন্তা যুক্তি এবং প্রমাণের দ্বারা চালিত। কিন্তু স্বকীয় চিন্তা যুক্তি এবং প্রমাণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নাও হতে পারে, যদিও তা কোন মতবাদ বা দৈব আদেশ (Divine Decree) এর উপর নির্ভর নয়। সেই ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা যুক্তিবাদের সমার্থক হতে পারে না। যেমন উত্তর-আধুনিকতাবাদ (Post-Modernism) বা বিশৃঙ্খলবাদ (Anarchism)। এই দুই মুক্তচিন্তা ভিত্তিক "বাদ" যুক্তি প্রমাণের উপর নির্ভর করেনা, আবার কোন প্রচলিত মতবাদ বা ধর্মীয় বিধানও স্বীকার করেনা। অনেকটা "যেমন খুশী তেমন ভাব" - এর মত ব্যাপার। যুক্তিবাদ এমন একটি দর্শন যা কঠোর মানসিক শৃঙ্খলা দাবী করে। কাজে ও কর্মে এটা অনুসরণ করা অনেকের কাছেই কষ্টকর ব্যাপার মনে হতে পারে। আবার অনেকে সত্যিকার অর্থে যুক্তিবাদী না হয়েও নিজেকে যুক্তিবাদী হিসেবে গণ্য করেন। এর কারণ হল তারা কিছু আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গীকে যুক্তিবাদের অংশ বলে মনে করেন, যদিও আসলে তা যুক্তিবাদের ফলশ্রুতি নয়। যুক্তিবাদের একমাত্র আবশ্যকীয় ফলশ্রুতি হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (Scientific Method)। একজন যুক্তিবাদী কোন রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি অন্ধ বা নি:শর্ত আনুগত্য বা সমর্থন প্রদর্শন করতে পারেন না। একজন যুক্তিবাদী অনির্বচনীয় বাক্যকে (Non-Propositional Statement) কে প্রমাণ বাক্য (Statement of Truth) বলে চালাতেও পারেন না। উদাহরণ স্বরূপ, যুক্তিবাদীরা এই ঘোষণা দিতে পারেন না যে "ইশ্বর নাস্তিমান", কারণ ইশ্বরের সঠিক ও অসঙ্গতিমুক্ত কোন সংজ্ঞা না থাকায় ইশ্বর কোন প্রতীত্য ধারণা নয়। তাই "ইশ্বর নাস্তিমান" এটা সত্যিকার অর্থে কোন বচন বাক্য (Proposition) নয়। কাজেই এটা প্রমাণ বাক্যও হতে পারে না । যুক্তিবাদীরা আস্তিকদের ইশ্বরের অস্তিত্বের দাবী ও তার সহায়ক যুক্তির ত্রুটিসমূহ অপোহের (Counter Logic, Dialectics) মাধ্যমে ধরিয়ে দিতে পারেন মাত্র। এর বেশী নয়। ইশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে যুক্তিবাদীরা তাই আবশ্যিকভাবেই অনবধানবাদী (Noncognitvist). তারা অজ্ঞেয়বাদীও(Agnostic) হতে পারেন না, কারণ অজ্ঞেয়বাদীরা ইশ্বরের সংজ্ঞা আছে ধরে নিয়েই (যদিও তারাও সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দিতে অক্ষম) কেবল এটাই বলেন যে ইশ্বর আছেন কি নেই এটা তাদের জানা নেই, বা প্রমাণের অভাবে এখনো জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যুক্তিবাদীরা ইশ্বরের সংজ্ঞা না থাকায় অজ্ঞেয়বাদীদের এই বাক্যকেও যুক্তিবহির্ভূত মনে করেন। যুক্তিবাদ এর আলোচনা থেকে অনেকের মনে হতে পারে যে যুক্তিবাদীদের কোন ব্যাপারে অভিমত থাকতে পারে না। কিন্তু তা ঠিক নয়। কোন অভিমত যদি যুক্তি, প্রমাণ ও পর্যবেক্ষণ বিরোধী না হয়, তাহলে তা যুক্তিবাদ বিরোধীও নয়। এরকম অভিমত যুক্তিবাদীরা পরীক্ষামূলকভাবে (Tentatively) নিতেই পারেন। তবে পরে প্রমাণ ও পর্যবেক্ষণ তা ভুল বলে প্রতীয়মান করতে পারে এই সম্ভাবনাকে মেনে নিয়ে খোলা মন রাখাও যুক্তিবাদের অংশ। প্রকল্প (Hypothesis) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রকল্পকে বৈজ্ঞানিক অভিমতই বলা যায়। প্রকল্প যখন বৈজ্ঞানিক আশ্রয়বাক্য (Premise) সহযোগে প্রপঞ্চবিষয়ক কোন প্রমাণবাক্য দেয় তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলা হয় (Scientific Theory)। তত্ত্ব যখন পুন: পুন: পর্যবেক্ষণের দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয় তখন তা বৈজ্ঞানিক সূত্র বা বিধি (Law) বলে গণ্য হয়। আগেই বলেছি যুক্তিবাদ কোন নির্বিচার মতবাদ (Dogma) এ বিশ্বাস করেনা। সেহেতু নির্বিচার মতবাদ ভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন ধর্মবাদী বা সাম্যবাদী রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক হতে পারেন না। কোন কোন বুদ্ধিজীবী বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শকে প্রগতিশীল আখ্যায়িত করে ভুলবশত যুক্তিবাদের সঙ্গে যুক্ত করেন। নির্বিচার মতবাদ ভিত্তিক নয় এমন রাজনৈতিক আদর্শ বা দলের ব্যাপারে অবশ্য যুক্তিবাদ নিরপেক্ষ। সেখানে ব্যবহারিক বিবেচনা ও সাধারণ জ্ঞানের মৌলিক প্রয়োগই যথেষ্ঠ। অনেক বুদ্ধিজীবী আবার মনে করেন যে যুক্তিবাদী মাত্রই গর্ভপাতের প্রশ্নে বৃতির (choice) পক্ষ নেবেন, বা মানুষের আচরণে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাবের প্রশ্নে পরিবেশের পক্ষ নেবেন, বা নৈতিক আপেক্ষিকতায় (Moral Relativism) বিশ্বাস করবেন ইত্যাদি। এগুলো ও ভ্রান্ত চিন্ত। যুক্তিবাদীরা বিজ্ঞানের আলোকেই শুধু বিচার বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিজ্ঞান ও যুক্তি যেখানেই চালিত করে যুক্তিবাদীদের সেখানেই দ্বিধাহীনভাবে যেতে প্রস্তুত থাকতে হবে, যদি তা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সহজাত প্রবৃত্তি জনিত পক্ষপাতিত্বের বিরূদ্ধেও যায়। সত্য অপ্রিয় হলেও তাকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়াই হচ্ছে যুক্তিবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। যুক্তিবাদ হৃদয়হীন। যুক্তি ও প্রমাণের কাছে নিজের আপনজন, প্রিয়জন, নিজের দেশ, ধর্ম, ভাষা কোনটারই বিশেষ স্থান নেই। যুক্তির কাছে সবই সমান ভাবে একই নিরীখে বিচার্য। একারণে যুক্তিবাদীর জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা বেশী নয়। যুক্তিবাদ রাজনৈতিক সঠিকতার ধার ধারতে পারেনা। সব মন্দ বা দোষ সমান এমন স্বীকরণ যুক্তিবাদ বিরোধী, যদিও রাজনৈতিক সঠিকতা তাই বলে। যুত্তি প্রমাণের মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা ভাল বা মন্দের মানগত তারতম্য নির্ধারণ করাই যুক্তিবাদ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যুক্তিবাদের কাছে জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ইত্যাদি গৌণ। যুক্তি ও প্রমাণই মুখ্য। কোন সময় যুক্তিবাদ জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে, আবার কোন সময় তার বিরুদ্ধে যেতে পারে। এমনকি মানবতাও যুক্তিবাদ থেকে লব্ধ কোন ধারণা নয়। মানবতা একটি পৃথক স্বত:সিদ্ধ হিসাবে গণ্য করা উচিত। মানবতা যুক্তিবাদের সঙ্গে যুক্ত হলে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি লব্ধ হয়। মূল্য বিচার (Value Judgement) যুক্তিবাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এখন প্রশ্ন হল প্রকৃত যুক্তিবাদী কোন নিরীখে বিচার্য? সবাই তো নিজেদের যুক্তিবাদী দাবী করতে বা ভাবতে চায়। ধর্মবাদী, সাম্যবাদী বা যে কোন "বাদী" রা ও দাবী করবেন যে তারা যুক্তি ও প্রমাণ মেনে চলেন। এই প্রশ্নের আলোচনায় একটু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। নির্বিচার মতবাদের সমর্থকদের যুক্তি ও প্রমাণ সার্বজনীন বা বস্তুনির্ভর (Objective) নয় । বস্তুত তাদের যুক্তি হল পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার উদ্দ্যেশ্যে যুক্তিবিজ্ঞানের নিয়ম বহির্ভূত নিজস্ব সৃষ্ট সুবিধাবাদী ও আত্মনির্ভর (Subjective) যুক্তি। কিন্তু যুক্তিবাদীদের যুক্তি হল সেই যুক্তি যা শত শত বছরের পরীক্ষিত, যা সার্বজনীন ও বস্তুনির্ভর, শিক্ষায়তনের পাঠ্যসূচীতে গৃহীত এবং যার প্রয়োগের মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সৃষ্টি, যার সাফল্য অবিসংবাদিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুক্তিশাস্ত্রের মধ্যে গুণগত কোন তফাৎ নেই। আশ্রয়বাক্যের (Premise) গঠন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু অনুমানের (Inference) পদ্ধতির বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। নির্ভূল যুক্তি যেহেতু বস্তুনির্ভর, সেহেতু আবশ্যিকভাবেই সার্বজনীন। এখন আসা যাক যুক্তিবাদ সম্পীকে কিছু ভুল ধারণার আলোচনায়। কেউ বলেন যে যুক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা ভুল। কারণ যুক্তিরও ভুল থাকতে পারে। কারণ যুক্তি তো মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুনতে "যুক্তিসঙ্গত" কথাই মনে হয়। কিন্তু মানুষের ভুলের জন্য যুক্তি ভুল হয় না। বরং মানুষের ভুল হয় বলেই যুক্তির উপর নির্ভর করা প্রয়োজন, যুক্তির সৃষ্টিই সেই কারণে। যুক্তিবিজ্ঞানের কোন নিয়ম বা পদ্ধতি ভুল প্রমাণিত হলে তা অবশ্যই সংশোধিত হত। তা ছাড়া কোন যুক্তি ভুল না শুদ্ধ সেটা যাচাই করতেও তো যুক্তি বা প্রমাণেরই আশ্রয় নিতে হয়, যুক্তি প্রমাণের বাইরে থেকে নয়। অনেকে যুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। যুক্তির সীমাবদ্ধতার মানুষের সীমাবদ্ধতারই প্রতিফলন। কিন্তু যুক্তির সীমাবদ্ধতার ধুয়া তুলে যুক্তির প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব অস্বীকার করা যায়না, বা যুক্তির চাইতে শ্রেয় কোন বিকল্পেরও প্রশ্ন ওঠে না। এবং এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই তো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সত্যকে সর্বদা পরীক্ষামূলক (Tentative) মর্যাদা দেয়। পরম সত্যের কোন স্থান নেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মানুষের ভুল হওয়ার সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সাথে স্বীকৃতি দেয়। অনেকে স্বজ্ঞা বা অভিকল্প (Intuition) কে সত্যকে জানার জন্য যুক্তি প্রমাণের চেয়েও উন্নততর পন্থা বলে মনে করেন। কিন্তু কোন বিশেষ ক্ষেত্রে স্বজ্ঞার দ্বারা সত্য জানা গেলেও এটা প্রমাণিত হয়না যে সাধারণভাবে স্বজ্ঞা যুক্তির চেয়ে শ্রেয়। যেমন কেউ একটি মুদ্রা নিক্ষেপ করলে কোন পিঠটি ওপরে থাকবে স্বজ্ঞার সাহায্যে বলতে পারলেন কোন একবার। বিজ্ঞানের সাহায্যে এটা বলা প্রায় অসম্ভব বটে। কিন্তু এতে বিজ্ঞান বা যুক্তি যে স্বজ্ঞার চেয়ে নিকৃষ্টতর তা প্রমাণ হয়না। তবে এটা বলাই বাহুল্য যে যুক্তি জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে সব সময়ে প্রযোজ্য হবে এটা মনে করাও ভুল। অনেক ক্ষেত্রে যেখানে সঠিক বা আগাম তথ্য জানা সম্ভব নয়, সেখানে অনুমানের ওপর নির্ভর করতেই হয়। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও যুক্তি সঠিক অনুমানের জন্য সহায়ক হতে পারে। যুক্তিবাদ জীবনের সর্ব প্রকার সমস্যা নিরসনের বা সব ব্যাপারে সাফল্যের গ্যারান্টিও নয়। যুক্তিবাদ জীবনের সর্বক্ষেত্রের (যেমন বিবাহ) সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারেও গ্যারান্টি দিতে পারেনা। অনেকে যুক্তিবাদ কে রসকষহীন, সৌন্দর্য বা রোমান্টিকতাহীন, মায়া মমতাহীন বলে হেয় জ্ঞান করেন। এটা এক ভিত্তিহীন চিন্তা। যুক্তিবাদ মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের পৃথকীকরণের ওপর জোর দেয়, হৃদয়কে সরিয়ে সেখানে মস্তিষ্ক বসানোর কথা বলেনা। কিছু কিছু মানবিক বৈশিষ্ট্য সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত, কাজেই তা যুক্তিবাদের আওতায় পড়েনা। প্রেম, ভীতি, পরোপকারিতা, বিবেক, ইত্যাদি জীববৈজ্ঞানিক সহজাত প্রবৃত্তি (Biological Instinct) তে নিহিত। যুক্তিবাদের এর সঙ্গে প্রবৃত্তির কোন সম্পর্ক নেই। সহজাত প্রবৃত্তি বহুলাংশে বংশাণুজনিত (Genetic), যা মস্তিষ্কের লিম্বিক তন্ত্র (Limbic System) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যুক্তিবাদী চিন্তা মূলত বংশাণুজনিত হলেও পরিবেশের প্রভাবেরও অবদান আছে, আর যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার নিয়ামক হল মস্তিষ্কের কর্টেক্স (Cortex) নামক অঙ্গ। লিম্বিক তন্ত্র সকল মানুষের মস্তিষ্কেই বিরাজমান। যুক্তিবাদের দ্বারা (অর্থাৎ কর্টেক্স এর দ্বারা) লিম্বিক তন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কাজেই অন্য সবার মতই একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি বিশেষ পরিবেশে ভীতি অনুভব করতে পারেন, বা কোন বিশেষ মানুষের জন্য গভীর আবেগ অনুভব করতে পারেন, কে যুক্তিবাদী আর কে ভাববাদী, বা কে বেশী যুক্তিবাদী আর কে কম, সেটা নির্ধরিত হয় তাদের কর্টেক্স এর পার্থক্যের কারণে। কিন্তু সব মানুষের লিম্বিক তন্ত্র অনুরূপ। তাই কোন অতীব সংকটময় মূহূর্তে, যেমন জীবন মরণ প্রশ্নে, যখন লিম্বিক তন্ত্র মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই মূথূর্তে যুক্তিবাদী বা অযুক্তিবাদীর মধ্যে আচরণগত কোন তফাৎ থাকেনা। কোন কোন রুচিও অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তিজনিত (যেমন খাবার রুচি)। তাই যুক্তির দ্বারা রুচি সৃষ্টি বা পরিবর্তিত হয়না। যুক্তিবাদকে হেয় করে দেখার আর এক কারণ হতে পারে যে অনেকে মনে করেন যে মানবিক কাজ করার প্রেরণা কেবল হৃদয় থেকে আসতে পারে, যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয়। আপাত দৃষ্টিতে কথাটি চিত্তাকর্ষক বটে। কিন্তু আগেই আভাস দিয়েছি যে পরার্থতা (altrusim), আত্মত্যাগের তাড়না ইত্যাদি জীববিজ্ঞানের মৌলিক তাড়নাতেই নিহিত। কাজেই কেউ যুক্তিবাদী হলেও তার সেই সহজাত প্রবৃত্তি বা তাড়নাটা বিলুপ্ত হয় না। যুক্তিবাদ বড়জোর সেই প্রবৃত্তির বহি:প্রকাশের রূপকে প্রভাবিত করতে পারে, প্রবৃত্তির কার্যকারিতা বা সুফলের উপর কোন ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারেনা। মানুষে মানুষে এই সহজাত তাড়নার তারতম্যের কারণ বংশাণুজনিত পার্থক্য। যুক্তিবাদের কোন অবদান নেই এই তারতম্যে। তবে যুক্তিবাদ সহজাত প্রবৃত্তি বা তাড়না সৃষ্টি বা নিয়ন্ত্রণ না করলেও, এই প্রবৃত্তি বা তাড়নার বহি:প্রকাশকে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সঠিক দিকে চালিত করতে পারে, যাতে তা অধিকতর কার্যকারী হয়। আবেগের দ্বারা চালিত পরার্থতা বা আত্মত্যাগ সবসময় সর্বাধিক কার্যকরী নাও হতে পারে। অবশ্য একজন যুক্তিবাদীও আবেগের দ্বারা পরার্থতা বা আত্মত্যাগ করতে পারেন। কারণ তা যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। যুক্তিবাদ সত্যিকার অর্থে যেখানে অভিমত, চিন্তা, বিচার, জানা, বোঝা ও সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন, সেখনেই প্রযোজ্য, যেখানে আবেগ বা মূল্যবিচারের প্রশ্ন, সেখানে নয়।