বিজ্ঞান,শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব - অপার্থিব বিজ্ঞান ও শিল্প বা কলার মধ্যে যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিদ্যমান সেটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই প্রবন্ধটি লেখার প্রয়াস। আমি পেশায় বিজ্ঞানী নই। তাই মৌলিক কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা এই লেখায় থাকবেনা। বিজ্ঞান লেখক হিসাবে আমার চেষ্টা হবে এই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বা সুচিন্িতত ধারণা গুলি, যা এই অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে প্রমাণ করে, সেগুলিকে সংকলিত করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা। এই লেখায় আমি বিজ্ঞান,কলা ও নান্দনিক অনুভূতি বা নন্দনতত্বের (Aesthetics) মধ্যকার সম্পর্কের তিনটি দিকের উপর আলোকপাত করব ঃ এক - বিজ্ঞান ও কলা বা নান্দনিক অনুভূতির অনুবন্ধ বা পারস্পর্য্য (Correlation) অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তিনির্ভর কলা বা নান্দনিক ধারণার অনুভূতির পেছনে কি কি বস্তুনির্ভর বৈজ্ঞানিক গুনক বা কারণ কাজ করে, দুই - শৈল্পিক চেতনায় মস্তিষ্কের ভূমিকা, এবং তিন - কলা ও নান্দনিক অনুভূতির বৈবর্তনিক উৎস, এই তিনটি নিয়ে। তবে এর আগে ঐতিহাসিক কিছু প্রসঙ্গের দীর্ঘ ভূমিকা। একটা বাঁধা বুলি প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, শিল্প বা শৌন্দর্য শুধু অনুভব করার ব্যাপার, যার চোখে বা মনে যেমন দেখায় তেমন করে। এখানে বোঝার বা ব্যাখ্যার কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? এই উক্তিকে এখন অসারবাক্যই বলা উচিত। বিজ্ঞানের আলোকে কোন কিছুই ব্যাখ্যাতীত নয়, বোঝার বা বোঝার চেষ্টার অযোগ্য নয়। শিল্প বা কলার সার্বজনীন কোন সংজ্ঞা হয়ত নেই ঠিকই, কিন্তু শিল্পকে বা শৈল্পিক অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা যায়না এটা আর মানা যায়না বিজ্ঞানের, বিশেষ করে বিবর্তন বিজ্ঞানের আলোকে। যার অস্তিত্ব সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত বা অনুভূত, তার কোন সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই, তাই তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলাটা একটা অসারবাক্যই শুধু। শিল্প ও সৌন্দর্য এমনই এক সার্বজনীন ধারণা। সংজ্ঞায়ন নয়, বরং এই সার্বজনীন ধারণার অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই মুখ্য ব্যাপার। বিবর্তন, বিশেষ করে বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হল মানুষের মনের এই সার্বজনীন শৈল্পিক ও নান্দনিক চেতনার উদ্ভবের কারণ খোঁজা, বিবর্তনের আলোকে। ঐতিহাসিকভাবে কবি এবং সাহিত্যিকদের মাঝে একটা বাঁধা ধারণা ছিল যে বিজ্ঞান ও কলা বা সাহিত্য পরস্পর বিরোধী। এখানে বিজ্ঞানকে ব্যাপক অর্থে বুঝিয়ে গণিত ও যুক্তিশাস্ত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করছি। ইংরেজ কবি কীট্স্ নিউটনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছিলেন যে আলোকের সূত্রের দ্বারা রংধনুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি রংধনুর সৌন্দর্যকেই ক্ষুণ্ন করেছেন। অথচ কীট্স্ ই আবার অন্য এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে সত্যই সৌন্দর্য্য। অন্যান্য কিছু পাশ্চাত্য কবিও বিজ্ঞানের প্রতি তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন যেমন ইউজিন কামিংস, এমিলি ডিকিনসন (যাঁর লেখা এক লাইন হল ‘‘নিভৃত কোন এক প্রান্তরের উপর রংগীন আলোর ছটা, যা বিজ্ঞান কখনই ছুঁতে পারবেনা, শুধু মানুষের প্রকৃতিই তা অনুভব করে ---’’), ওয়ার্ড্স্ওয়ার্থ প্রমুখ। আর এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বিজ্ঞানবিমুখ এই বাঁধা ধারণায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন তিনি হলেন ফরাসী দার্শনিক রুশো। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর রীতিমত বিশ্রদ্ধাই ছিল। বিজ্ঞান ও শিল্প বা সাহিত্যের এই ঐতিহাসিক বিরোধের এর উপর ‘The Two Cultures and the Scientific Revolution ‘ (দুই সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব) নামে এক বিখ্যাত বই লিখেছিলেন C.P. Snow. দুই সংস্কৃতি বলতে তিনি বিজ্ঞান ও শিল্প বা সাহিত্যকেই বুঝিয়েছেন। এই বইতে তিনি কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে বিজ্ঞান এর প্রতি সাধারণ এক অবজ্ঞাসূচক মনোভাব ও বৈজ্ঞানিকদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার না করার প্রবণতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই বিষয়ে প্রয়াত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান কে জড়িয়ে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া যাবে ক্রিস্টফার সাইক্স্ (Christofer Sykes) এর লেখা ‘No Ordinary Genius ‘ নামক বইতে। ফাইনম্যানকে তাঁর এক শিল্পী বন্ধু হাতে একটা ফুল ধরে তাঁর দিকে তাক করে বলেন, ‘‘একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই ফুলের সৌন্দর্য হূদয়ঙ্গম করতে সক্ষম, আর তুমি এটাকে ভেঙ্গে চূরে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর সৌন্দর্যকেই বিলীন করে দাও’’। এর উত্তরে ফাইনম্যান বলেছিলেন যে একজন শিল্পী ফুলে যে সৌন্দর্য দেখতে পান, তিনিও সেই একই সৌন্দর্য দেখতে পান, কিন্তু উপরন্তু তিনি ফুলের ভেতরকার সৌন্দর্যকেও দেখতে পান, যেমন কি ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা ফুলের পাপড়ি গঠিত হয়, কিভাবে বৈবর্তনিক উপযোজনের কারণে কীটপতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য ফুলের সুন্দর রঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, এইসব, যা থেকে তাঁর শিল্পী বন্ধু বঞ্চিত। আর একজন কবি, ওয়াল্ট হুইট্ম্যান তাঁর কবিতা ‘‘যখন বিজ্ঞ জ্যোতির্বিদকে বলতে শুনলাম’’ (“When I Heard the Learn'd Astronomer”) কবিতায় লিখেছেন কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এক বক্তৃতা শুনতে শুনতে একঘেয়েমি বোধ করে কবি বক্তৃতাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান বাইরে রহস্যময় রাতের আঁধারে, যাতে একান্ত নিভৃতে আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকতে পারেন। হুইটম্যানের এই লাইনগুলির যথার্থ প্রত্যুত্তর দিয়েছেন বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ওয়াইজ্কফ। তিনি হিউবার্ট রিভ্স এর লেখা ‘‘Atoms of Silence'’ বইটির মুখবন্ধে বলেন ‘‘হিউবার্ট রিভ্স বিজ্ঞ জ্যোতির্বিদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু জানেন ও বোঝেন। কিন্তু ওয়াল্ট হুইট্ম্যান এর মত রাতে তিনিও আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকতে পছন্দ করেন। হুইটম্যানের কবিতার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ফাইনম্যান তাঁর বিখ্যাত ফাইনম্যান বক্তৃতা সিরিজে লিখেছেন, তিনিও হুইট্ম্যান এর মত নির্জন রাতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে পুলক ও রোমাঞ্চ অনুভব করেন, কিন্তু তাঁর এই রোমান্টিক অনুভূতি কয়েকগুন বেড়ে যায়, যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে ঐ তারার আলো তাঁর চোখে পৌঁছুতে লক্ষ লক্ষ বছর নিয়েছে, এবং যখন এটা উপলব্ধি করেন যে তাঁর দেহ যে উপাদান দ্বারা গঠিত তাও সুদূর অতীতে কোন অতিনবতারার বিস্ফোরণের দরুণ বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ বৈ কিছু নয়। এই যে বাড়তি কিছু জানা, তা এই রহস্যটার কোন ক্ষতি করেনা, কারণ সত্য এক অদ্ভুত সুন্দর জিনিষ, যা অতীতের কোন শিল্পী কখনো কল্পনাও করতে পারেননি। প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আইজাক আজিমভ তাঁর বই ‘‘The Roving Mind ‘‘ এ ‘‘বিজ্ঞান ও সৌন্দর্য’’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন ‘অবশ্যই রাতের আকাশ সুন্দর, কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা কি রাতের আকাশের আরও বাড়তি এক গভীর সৌন্দর্যকে তুলে ধরেননা? এর পর তিনি কাব্যিক ভাষায় নক্ষত্র, ছায়াপথ ও মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে একের পর এক অধ্যায় লিখে যান। এটা সত্যি খুবই দুঃখজনক যে অতীতের নামী দামী সাহিত্যিকেরা বিজ্ঞানের প্রতি কটাক্ষ করে বিজ্ঞানকে সাহিত্যের বিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদেরকে রহস্য ও সৌন্দর্য বিনাশকারী বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। কারণ বিজ্ঞান আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও রহস্যবোধকে আরও জোরদার করে। প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই রহস্যকে আর এক ধাপ নীচে ঠেলে দেয়। রহস্যের পরিসমাপ্তি ঘটায় না। চুড়ান্ত রহস্যের হাতছানি বৈজ্ঞানিকদের এগিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত করে, অজানাকে জানবার ইছা ও সিসৃক্ষার (যা শৈল্পিক চেতনার এক অপরিহার্য্য উপাদান) সনাতন প্রবৃত্তিকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে। বিখ্যাত বৃটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যর জেম্স জীন্স তাঁর ‘"The Nature of the Physical World’’ বইয়ের ‘‘বিজ্ঞান ও অধ্যাত্মবাদ’’ প্রবেন্ধ তাঁর লেখা উদ্গতিবিজ্ঞানের পাঠ্য বইয়ের বায়ু ও তরঙ্গ বিষয়ক পাতাগুলি থেকে কয়েকটি লাইন উধৃতি দিয়ে এর তুলনা করেন বাস্তবে সমুদ্রের তীরে বসে সূর্যের আলোøাত ঢেউএর নৃত্যলীলা দেখার নান্দনিক অনুভূতির সাথে। আইনস্টাইন প্রকৃতির মধ্যে যে অপূর্ব প্রতিসাম্য পরিলক্ষিত হয় তাকে সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে কেবল দেখেন ই নি, এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অপেক্ষিকতার সুগভীর তত্বও আবিষ্কার করেছিলেন। নিউ ইয়র্ক টাইম্সের ১৯৩৫ সালের ১লা মে’র সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, বিশুদ্ধ গণিত যেন একরকম কবিতা, যৌক্তিক ধারণার কবিতা। আরেক নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ডিরাকও পদার্থবিজ্ঞানে সৌন্দর্যের যথার্থ উপলব্ধি ও তার প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ডিরাক সমীকরণের (যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান) পেছনে এই সৌন্দর্যের উপলব্ধি ও কদরকেই কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। তিনি দাবী করেন যে এক তীক্ষ্ন সৌন্দর্যসচেতনতাই তাঁকে ১৯২৮ সালে ইলেক্ট্রনের তরংগ অপেক্ষক বা Wave Function আবিষ্কারে সাহায্য করে। ১৯৬৩ সালের মে মাসের Scientific American পত্রিকায় এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেনঃ ‘‘আমার মনে হয় এই গল্পের একটা শিক্ষণীয় বাণী আছে, আর সেটা হল যে কোন সমীকরণে সৌন্দর্য থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সমীকরণটি পর্যবেক্ষণের সাথে মিলল কি না আগেই তার বিচারে যাওয়াটা নয়। কেউ সমীকরণে সৌন্দর্যের দৃষ্টিভংগী ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে এগোলে প্রগতির পথ সুনিশ্চিত হবে। কারও তত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের একশ ভাগ সঙ্গতি না হলেও হতাশ হবার কিছু নেই। কারণ এই সামান্য গরমিল হয়তো বা কোন ছোটখাট ব্যাপার যথাযথ ভাবে খেয়াল না করার কারণেই ঘটেছে যা পরবর্তীতে তত্বকে আরও পরিশীলিত করলে দূরীভূত হতে পারে।’’ নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর যেমন কৃষ-গহবরের গাণিতিক তত্বের উপর ৬৫০ পৃষ্ঠার এক বিশাল ও জটিল বই লিখেছিলেন তেমনই ‘‘সত্য ও সৌন্দর্য’’ নামে একটি বই লিখেছিলেন যেখানে তিনিও ডিরাকের মত বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার পেছনে সৌন্দর্যবোধ থাকাটর উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি শেক্স্পিয়ার, বেটফেন, শেলী প্রমুখের শিল্পসৃষ্টির সাথে সৌন্দর্যচেতনায় উদ্বুদ্ধ বিজ্ঞানীদের সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টার তুলনা করেন। কাজেই দেখা যাছে যে অনেক আবিষ্কারের প্রেরণার পেছনে আছে সৌন্দর্য ও মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি এক আধ্যাত্মিক আকর্ষণ । স্যার জগদীশ্চন্দ্র বোস তাঁর ‘‘কবিতা ও বিজ্ঞান’’ প্রবন্ধে বিজ্ঞান ও কবিতার বা সৌন্দর্যের মধ্যে বিরোধহীনতার বা অন্তর্দ্বন্দের অভাবের কথা বলেছেন। আরও পরে গণিতজ্ঞ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর প্রবন্ধ ‘‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’’ এও সেই একই কথাই বলেছেন। বিজ্ঞান ও কলার এই অবিরোধের বাণী প্রচারের জন্য একজন ইংরাজী সাহিত্যের ও একজন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের যৌথ উদ্যোগে লেখা বইয়ের চাইতে বেশী উপযোগী আর কি হতে পারে? এমন একটি বই হল Thomas Vargish Delo ও E. Mook এর লেখা ‘‘Inside Modernism: Relativity Theory, Cubism, Narrative” নামক বইটিতে। এই বইটিতে তাঁরা লিখেছেনঃ ‘‘আমরা আপেক্ষিকতার বিশেষ ও সাধারণ তত্বকে আর আধুনিকবাদী শিল্পসৃষ্টিকে একই দৃষ্টিতে দেখি, কারণ উভয়ের মধ্যেই আছে আধুনিকবাদী মূল্যের এক জোরাল প্রকাশ।’’ এই বই সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে নিম্নের ওয়েব সাইটে ক্লিক করুনঃ http://yalepress.yale.edu/YUPBOOKS/book.asp?isbn=9780300076134 বিংশ শতকের গোড়ার দিকের বিখ্যাত গাণিতিক G.N. Watson বলেছিলেন যে মাইকেল এঞ্জেলোর সৃষ্ট ফোরেন্সের স্যান লোরেনজোর মেডিচি চ্যাপেলের (Medici chapel in the San Lorenzo in Florence) এর ‘‘দিবস/রজনী/সায়াহ¡/প্রভাত’’ ভাস্কর্যকর্ম তাঁকে যেভাবে রোমাঞ্চিত করে রামানুজানের কোন কোন গাণিতিক সূত্র তাঁকে ঠিক একই ভাবে রোমাঞ্চিত করে। (এর উল্লেখ পাওয়া যাবে Roger Penrose এর লেখা বই ‘‘The Emperor's New Mind’’ এর ৫৪৫ পৃষ্ঠায়) সম্প্রতি প্রয়াত কোয়ান্টাম পদার্থবিদ ও দার্শনিক ডেভিড বম তাঁর ‘‘বিজ্ঞান ও শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক’’ নামক নিবন্ধে বিজ্ঞান ও শিল্পের বিকাশের মধ্যে মিলের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি শিল্পখেত্রে মনে ((Monet)ও সেজানের শিল্পশৈলী থেকে ত্রিমাত্রিকবাদীদের ও মন্ড্রিয়ান এর বিমূর্ত শিল্পশৈলীর ক্রমবিকাশের সাথে বিজ্ঞান ও গণিতে প্রতীক বা প্রতিরূপের স্থলে বিশুদ্ধ কাঠামো বা অবয়বের দিকে ক্রমবিকাশের তুলনা করেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিল্পকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না বা করার অর্থ হয় না। শিল্পের ধারণা মানুষের মনের উপর তার প্রভাব থেকেই প্রতীয়মান। শিল্পকে যদি মানুষের মনে তার সৃজনশীল সৃষ্টির আনন্দের দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় তাহলে বিজ্ঞান সহজেই একটি শিল্পরূপ এবং বিজ্ঞানীরা এই শিল্পরূপের শিল্পী। বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা শিল্পের রস আস্বাদন করতে পারেন না এটা বলা ভিত্তিহীন যেমনটি বলা ভিত্তিহীন যে একজন সংগীতশিল্পী কবিতা উপভোগ করতে পারবেন না। সূত্র বা তন্তুতত্ব (String Theory) সূক্ষ শিল্পকর্মের চেয়ে কোন অংশে কম উন্নত নয়। একজন সূত্রতত্ববিদ সুগভীর শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের দ্বারাই তাঁর গবেষণা পরিচালিত করেন। এটা কম বেশী সব বৈজ্ঞানিক শাখার খেত্রেই প্রজোয্য। ১৭ ই জুলাই ২০০৩ সালের Nature ম্যাগাজিনে ‘‘ যদি বিজ্ঞানের ব্যাপারে কোন বিশেষ একটি ব্যাপারে জনগণকে অধিকতর সচেতন করতে চান তাহলে আপনি কি বলবেন?’’ এই প্রশ্নের উত্তরে আণবিক জীববিজ্ঞানের অধ্যাপিকা Bonnie Bassler বলেন ‘‘বলব যে আমরা বিজ্ঞানীরা মোটেই কাটখোট্টা নই,আমরাও শিল্পী, আমরা যা করি সেটাও শিল্পকর্মের মতই উত্তেজনাকর, আনন্দময় ও সৃজনশীল।’’ এবারে আসি আলোচ্য বিষয়ের প্রথম দিকটায়। বিজ্ঞান ও শিল্প কলার মধ্যেকার সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন এবং সাম্প্রতিক বিজ্ঞানীরাও এটা নিয়ে মাথা ঘামাছেন। কোন কোন বিজ্ঞানী সুন্দর বলে বিবেচিত বস্তুর সুন্দর বিন্যাস,কারুকার্য্য বা নক্সার পেছনে কোন কোন গাণিতিক বিন্যাস বা pattern আবিষ্কার করেছেন। এই সব আবিষ্কারের পরিণতিতে ‘গণনামূলক নন্দনতত্ব’’ (Computationa Aesthetics) নামে জ্ঞানের এক শাখার সৃষ্টি হয়। এই শাখার পথিকৃৎ হলেন বিশিষ্ট মার্কিন গণিতজ্ঞ ও আমেরিকান গাণিতিক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি (১৯২৪-১৯২৬) ডেভিড বার্কফ যাঁর বিখ্যাত আর্গোডিক প্রকল্প্ব (Ergodic Hypothesis) এর সাথে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বা শিক্ষকরা সুপরিচিত। কুড়ির ও তিরিশের দশকের সময় তিনি সৌন্দর্যের উপর বস্তুনির্ভর ধারণা আরোপের চেষ্টা করেন যেমন বিন্যাস, জটিলতা ও সৌন্দর্যগুণক ইত্যাদি। এই সময় এ নিয়ে তিনি একটা প্রবন্ধও লেখেন যার শিরোনাম ছিল ‘‘কান্তিবিদ্যার গাণিতিক তত্ব এবং কবিতা ও সংগীতে এর প্রয়োগ’’ যা প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের রাইস ইনস্টিটিউট পুঞ্জিকার ১৮৯-৩৪২ পৃষ্ঠায়। এর পর পরই তিনি তাঁর গবেষণা ব্যাখ্যা করার জন্য বক্তৃতা সফরে বে হন। তাঁর বস্তুনির্ভর ধারণার ভিত্তিতে কিছু গণনার দ্বারা তিনি দেখাতে সমর্থ হন যে কেন তুষার কণা, ফুল ইত্যাদি অন্য অনেক বস্তুর চেয়ে সুন্দর। সুর ও কবিতার শ্রবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত মাত্রার কিছু সূত্রও তিনি উদ্ভাবন করলেন। এর পরে পঞ্চাশের দশকে জার্মানীতে সাহিত্যতাত্বিক এক গোষ্ঠিা, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন Max Bense, তাঁরা বার্কফের মত কান্তি বিচারের এক মডেল, তথ্যমূলক কান্তিবিদ্যার (Informational Aesthetics) আবিষ্কার করেন, যা Claude Shannon এর তথ্যতত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ষাট দশকের শেষভাগে এর আরও বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হন Nijmegen এর মনোবিজ্ঞানী Emmanuel Leeuwenberg । আমি কেবল এই বিজ্ঞানীদের কাজের কথারই উপরি উপরি উল্লেখ করলাম। এদের কাজের ভেতরের খুঁটিনাটি দেয়া সম্ভব নয়। সজাগ পাঠকেরা এটা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে উপরোক্ত তত্বসমূহ কেবল ব্যক্তিনির্ভর (Subjective) সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে বস্তুনির্ভর (Objective) বৈজ্ঞানিক মাপ এর এক অনুবন্ধী সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস মাত্র। কিন্তু কি কারণে সুন্দর বস্তুর ঐ বস্তুনির্ভর ধর্মগুলি মানুষের মনে ব্যক্তিনির্ভর সৌন্দর্যের অনুভূতির সৃষ্টি করে ঐ তত্বসমূহ সেটা ব্যাখ্যা করেনা। এর জন্য আমাদের বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হবে। যেহেতু বিবর্তনের অবিসংবাদিত এক সত্য হল এই যে মানুষ তথা মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট সেহেতু এটা বলাই বাহুল্য যে সৌন্দর্যবোধ, শিল্পসিসৃক্ষা, নৈতিকতা তথা মানুষের সকল বৈশিষ্ট যা মানুষের মস্তিষ্কে সৃষ্ট তাও বিবর্তনের ফল। এগুলি কোন দৈব শক্তির দ্বারা মানুষের মগজে রোপিত হয় না যদিও কেউ কেউ এটাই বিশ্বাস করেন। আমাদের মধ্যে কাউকে এটা বলতে শোনা যায় যে প্রেম, ফুল বা শিশুর সৌন্দর্য এ সবই এক দৈব বা স্বর্গীয় সৃষ্টি। আসলে এই উক্তি ঐ সৌন্দর্যের প্রতি তাদের মনের বিস্ময়াপ্লুত আবেগেরই প্রকাশ মাত্র, যার কারণ হল প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দ্বারা এই সৌন্দর্যকে বোঝার অপারগতা, বা আদৌ যে এর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা সম্ভব এই চিন্তাটাও মাথায় না আসা। তাই অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাই (যদিও প্রকৃত অর্থে তা ব্যাখ্যা নয়) তাঁরা বেছে নেন। সৌন্দর্য (বস্তুর বিশেষ ধর্ম অর্থে) ও সৌন্দর্যবোধ (মানুষের মনের এক অনুভূতি অর্থে) এ দুটো হল পরস্পর সম্পূরক দুটি বিবর্তনীয় সৃষ্টি। জড় বস্তুর সৌন্দর্য (যেমন তুষার ফলকের বা রংধনু ইত্যাদি) সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে সৃষ্ট, আর জীবের (প্রাণী ও উদ্ভিদ) সৌন্দর্য বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট, যদিও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বিবর্তনও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের এক পরিণতি। সৌন্দর্যের প্রতি আসক্তি মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। এই সৌন্দর্য কোন বস্তুর (জড় বা জীব) মধ্যে বিধৃত হতে পারে, আবার কখনও বা অমূর্ত ধারণায় বিধৃত হতে পারে যেমন গানে বা কবিতায় । কিন্তু যেটাই হোক, এই দুইয়ের একটা সাধারণ ব্যাপার হল যে উভয় ক্ষেত্রেই সৌন্দর্যের উৎস হল এক অন্তির্নহিত তথ্য বা বিন্যাস (Information or Pattern) যা মানুষের মস্তিষ্কের আনন্দকেন্দ্রে সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি করে। কাজেই গভীর প্রশ্ন হল কিভাবে সৌন্দর্যের উৎস এই তথ্য বা বিন্যাস এর সঙ্গে মস্তিষ্কের আনন্দকেন্দ্রের এই কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হল। আগেই উল্লেখ করেছি মানুষের অনুভূতি সংক্রান্ত সব বৈশিষ্ট্যই বিবর্তনের ফল। বৈশিষ্ট্যগুলি বৈবর্তনিক নির্বাচনজনিত চাপের (Evolutionary Selection Pressure) মুখে উদ্বর্তনের জন্য উপযোজনীয় কৌশল হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট হতে প[রে অথবা উদ্বর্তনের উপযোজনীয় কৌশলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা উপজাত হিসেবে পরোক্ষভাবে সৃষ্টি হতে পারে। এই উপজাত কে বিবর্তনের স্প্যান্ড্রেল (Spandrel) বলা হয়। স্প্যান্ড্রেলের স্বকীয় কোন উদ্বর্তন মূল্য (Survival Value) নেই। স্প্যান্ড্রেল হল কোন ইমারত নির্মানের সময় খুঁটি বা ম্ভম্ভগুলির বাড়তি অপ্রয়োজনীয় অংশগুলি যা ইমারত নির্মাণের আবশ্যকীয় উপজাত হিসেবে তৈরী হয়। সৌন্দর্যের অনুধাবন বা আসক্তি অনেকাংশে (সব গুলি নয়) এই বিবর্তনের স্প্যান্ড্রেল। এই প্রসঙ্গে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেই যে বিবর্তনের ভাষায় উদ্বর্তন বলতে পরবর্তী প্রজন্মে বংশাণুকে হস্তান্তর করাকেই বোঝায়। শারীরিক অর্থে বেঁচে থাকাটাই নয়। কেউ যদি সন্ততিতে বংশাণু সংক্রমিত করে তারপর মৃত্যু বরণ করে তাহলে বিবর্তনের ভাষায় সে উদ্বর্তিত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। মানুষের দেহ হল বংশাণু মজুত রাখার এক সাময়িক ভান্ডার মাত্র। বংশাণু রক্ষাই হল বিবর্তনের একমাত্র লক্ষ্য। একটি বংশাণু লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে চলেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। এর মাঝে বিভিন্ন মানূষ ঐ বংশাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে মাত্র। এবার এই নতুন গবেষণার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কাজের কিছু উল্লেখ করি। কান্তিবিদ্যার মূল যে জীববৈজ্ঞানিক সেই অভিমত আগেই একজন অবিজ্ঞানী সাহিত্যিক ফ্রেডারিক টার্নার ই দিয়েছিলেন তাঁর ‘‘Natural Classicism’’ বইটিতে। এই বইতে তিনি এই মত ব্যক্ত করেন যে মানুষের কান্তিবোধ প্রাক্যুগের জীববৈজ্ঞানিক তাড়নার কারণেই সৃষ্ট। কিন্তু এ বিষয়ে বিবর্তন বিজ্ঞানের সূক্ষ ও সযত্ন বিশ্লেষণের দ্বারা প্রথম যে বই লেখা হয় যা পরবর্তীতে আন্যান্য বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করে সেটি হল বিভিন্ন গবেষকদের লেখা নিয়ে সংকলিত ১৯৯২ তে প্রকাশিত বই "The Adapted Mind: Evolutionary Psychology and the Generation of Culture”, যার সম্পাদনায় ছিলেন বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানী Jerome H. Barkow, Leda Cosmides, ও John Tooby । আর একটি বহুল প্রসংসিত বই হল ন্যান্সি আইকেন এর লেখা ‘‘The Biological Origin of Arts’’। এই বইয়ের মূল বক্তব্য তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘‘An Evolutionary Perspective on the Nature of Art’’ এ পাওয়া যাবে। এই প্রবন্ধ পড়তে চাইলে পাঠক http://www.apa.org/divisions/div10/articles/aiken.html সাইট এ ক্লিক করতে পারেন। আইকেনের বই অবশ্য এর আগে Dissanayake এর লেখা “Homo aestheticus: Where art comes from and why” বইয়ের ধারণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। ব্রেট কুক ও ফ্রেডারিক টার্নার এর সম্পাদিত একটি বই ‘‘Biopoetics: Evolutionary Explorations in the Arts’’ এ সম্পাদকেরা বলেন যে ‘’শিল্পের সৃজন বা উপভোগ করার জন্য আমাদের মধ্যে নিহিত সনাতন প্রবৃত্তিকে বুঝতে চাইলে যে আমাদেরকে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাস বা ঐতিহ্যের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে তার সাক্ষ্য প্রমাণ বেড়েই চলেছে। আমরা যদি স্রেফ শিল্পের খাতিরে শিল্প এই কথাও বলি তবুও এটা আবশ্যক যে ডারুইনীয় অর্থে শিল্পের খাতিরে শিল্প বলতে কি বোঝায় সেটা বুঝতে চেষ্টা করি ’’ শিল্পের বৈবর্তনিক উৎস নিয়ে একটি সুলিখিত সন্দর্ভ হল ‘‘শিল্প কি একটা উপজোযন? সৌন্দর্যের প্রতি বৈবর্তনিক দৃষ্টিভংগীর সম্ভাবনা’’ (‘Is Art an Adaptation? Prospects for an Evolutionary Perspective on Beauty ‘) যার লেখক টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক রোনাল্ড ডি সুসা। সন্দর্ভটি প্রকাশিত হয় জুন ২০০৪ সালের কান্তিবিদ্যা ও শিল্পসমালোচনার সাময়িকীতে ((The Journal of Aesthetics and Art Criticism, Volume 62 Issue 2 Page 109 - June 2004)। পাঠকেরা এটা পড়তে চাইলে ক্লিক করতে পারেন সুসার নিজের সাইটেঃ http://www.chass.utoronto.ca/~sousa/artfunction/art.htm ‘‘বিবর্তন ও সাহিত্যতত্ব’’(‘Evolution and Literary Theory ‘) বইটিতে লেখক জোসেফ ক্যারল শিল্পের (বিশেষ করে সাহিত্য) ডারুইনীয় ব্যাখ্যার সপক্ষে শুধু যুক্তি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, শীর্ষ আধুনিকোত্তরবাদী বা অবয়বোত্তরবাদীদের (Postmodernist /poststructuralist)) বিশেষ করে দেরিদা, ফুকো ও তাঁদের শিষ্যদের নির্বিচারবাদী পাঠবাদের (Textualism) এই যুক্তিও খন্ডন করেন যে শিল্পসাহিত্যে বস্তুনির্ভর কোন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। আগ্রহী পাঠকেরা ক্যারলের লেখা পড়তে চাইলে এই সাইটে ক্লিক করতে পারেনঃ http://www.umsl.edu/~engjcarr বৃটিশ বিজ্ঞানী ও লেখক জন ব্যারো তাঁর "Between Inner Space and Outer Space'’ বইএর ‘‘কান্তিবিদ্যা’’ নামক অধ্যায়ে কিভাবে প্রাচীন মানবের মধ্যে উপজোযনের তাগিদে সৌন্দর্যচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য সম্বলিত চিত্রের বা Landscape Art এর প্রতি আদিম মানব এর আকৃষ্ট হবার কারণ হিসেবে এর উদ্বর্তনী মূল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। আদিমকালের আফ্রিকান মহাদেশে বিপদশংকুল চারণভূমিতে, যেখানে হিংস্র জীবব্জন্তুর আক্রমণের ভয় সদাবিরাজমান, সেখানে উন্মুক্ত ও সুষম খোলা প্রান্তর বেঁচে থাকার পক্ষে সহায়ক, কারণ সেখানে সহজেই হিংস্র প্রাণীকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখা যায়। কাজেই যারা এই ধরণের প্রতিসাম্যপূর্ণ বিস্তীর্ন প্রান্তরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত তারাই উদ্বর্তনের দৌড়ে এগিয়ে ছিল। প্রতিসাম্যের প্রতি আকর্ষণ উদ্বর্তনের ব্যাপারে সাধারণভাবে অধিকতর সহায়ক ছিল বলে বিবর্তনবিজ্ঞানীদের অভিমত। আর এই প্রতিসাম্যের প্রতি আসক্তি ই পরবর্তীতে সুন্দর জিনিষের প্রতি আসক্তির উৎস হয়ে যায়। ব্যারো আরও বলেন কোন কোন বিশেষ আকার বা রঙ্গের প্রতি আসক্তি আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য উদ্বর্তনের সহায়ক উপযোজন হিসেবে কাজ করেছিল, যা পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে ফুল, চিত্রকলা,নক্সা ইত্যাদির প্রতি আসক্তির রূপ নেয়। কাজেই দেখা যাছে শৈল্পিক বা নান্দনিক আসক্তির একটা উপযোগীয় কারণ ছিল। সময়ের সাথে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সেই উপযোগজনিত কারণ কমে গেছে বা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রয়োজন ফুরালেও তখনকার সৃষ্ট সেই সৌন্দর্যচেতনা ফুরিয়ে যায়নি। কশেরুকার নীচের coccyx নামক অঙ্গের মতই অতীতের সাক্ষর হয়ে এখনও বিরাজমান। অবশ্য সেই সৌন্দর্য চেতনারও অনেক রুপান্তর ঘটেছে, সেটাও বিবর্তনের কারণে। বেটফেনের ‘‘পঞ্চম সিম্ফনি’’ বা রবীন্দ্রনাথের ‘‘সোণার তরী’’ তারই উদাহরণ। ব্যারো আরও একটা উদাহরণ দিয়ে যুক্তি দেন যে সংগীতের প্রতি আসক্তিও বিবর্তনভিত্তিক। এর সপক্ষে উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের দুই জন পদার্থবিজ্ঞানীর এক আবিস্কারের উল্লেখ করেন। তাঁরা দেখলেন যে সব সভ্যতা বা কৃষ্টিরই সবচেয়ে জনপ্রিয় ধ্রুপদী বা আধুনিক সংগীতের সুরের মধ্যে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যকে শব্দবিজ্ঞানে বলা হয় 1/f type spectral noise .তাঁরা এই বৈশিষ্ট্য কম্পাঙ্কের এক বিরাট প্রসার বা range এর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন। সকল কৃষ্টির মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যের সার্বজনীনতাই মানুষ প্রজাতির সংগীতের প্রতি আসক্তির এক সার্বজনীন বিবর্তনীয় ভিত্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কারণ এটা খুবই কাকতালীয় ব্যাপার হত যদি সব সংস্কৃতিতেই একইরকম সংগীতের প্রতি আকর্ষণের উদ্ভব হত বিবর্তন ব্যতীত। এছাড়া মস্তিষ্ক যে এক বিশেষ সুরধ্বনির সঙ্গে সমন্বিত, যা আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় জানা গেছে (যার উল্লেখ পাওয়া যাবে ৪ঠা নভেম্বর ২০০৪ সংখ্যার সায়ন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় Norman Weinberger এর লেখা মস্তিষ্ক ও সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধে), সেটাও প্রমাণ করে যে সংগীতের উৎপত্তিও বিবর্তনজনিত, কারণ মস্তিষ্ক নিজেই বিবর্তনের কারণে সৃষ্ট। আবার এটাও জানা গেছে যে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ও ভ্রূণ বিভিন্ন সুরের প্রতি বিভিন্নপ্রকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সংগীত বিচারে সক্ষম, যার উল্লেখ পাওয়া যাবে Robin Maconie এর ‘‘সংগীত বিজ্ঞান’’ (The Science of Music) বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায়। এর দ্বারাও এটা বোঝা যায় যে সংগীত জ্ঞান বংশাণুগত, সেহেতু বৈবর্তনিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। মস্তিষ্ক ও সংগীতের মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়ে আর একজনের গবেষণার কথা উল্লেখ করতে হয়। আর তিনি হলেন আমেরিকার সান ডিয়েগোতে ক্যালিফরনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্তিষ্ক ও অবধারণ কেন্দ্রের মস্তিষ্কবিজ্ঞানী রামাচন্দ্রন, যাঁর লেখা বই ‘Phantoms in the Brain‘ সুপরিচিত। তিনি ও তাঁর সহকর্মী Hirstein চেতনা বিষয়ক সাময়িকী The Journal of consciousness Studies, 6/7, 15-41 তে ‘‘শিল্পের বিজ্ঞান’’ বা ‘The science of art‘ নামক প্রবন্ধে স্নায়বিক গবেষণার ভিত্তিতে লব্ধ শিল্পরসবোধের বিভিন্ন দিকের উপর তাঁদের মতবাদ জানান, যেমন (ক) শিল্পের যুক্তি, অর্থাৎ কোন সার্বজনীন সূত্র আছে কিনা, (খ) বৈবর্তনিক কারণ, অর্থাৎ এই সূত্রগুলির বিকাশ হল কিভাবে এবং সূত্রগুলির রূপটি যেমন তেমনটিই বা হল কেন এবং (গ) মস্তিষ্কের কোন বর্তনী এতে জড়িত ইত্যাদি। এই সবের উপর ভিত্তি করে তাঁরা তাঁদের ‘‘নান্দনিক অনুভূতির আটটি বিধি’’ প্রস্তাব করেন, অনেকটা বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টমার্গের মত। সৌন্দর্যানুভূতির একটি বিশেষ দিক হল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৌন্দর্যানুভূতি। এটাও বৈবর্তনিক ভিত্তিতে ভালভাবেই বোঝা গেছে। বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের অনুসন্ধানে জানা যায় যে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে যে সকল বৈশিষ্ট্যকে সুন্দর বলে প্রতীয়মান হয় সেগুলো আসলে বংশাণবিক যোগ্যতারই (Genetic Fitness) নির্দেশক। বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী নর ও নারীদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলির সন্ধান করেছেন। তাঁদের মধ্য প্রধান হলেন দেবেন্দ্র সিংহ ও ডেভিড বুস (Buss) প্রমুখ। আর দুজনের নাম উল্লেখ করে শেষ করছি। জীববিজ্ঞানী ও লেখক ম্যাট রিডলী তাঁর বই ‘‘The Red Queen” এ মস্তিষ্কে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৌন্দর্য বোধের কারণ হিসেবে বিবর্তনের এক বিশেষ দিক বা যৌন নির্বাচনকে (Sexual Selection) চিহ্নিত করে এ নিয়ে সুবিস্তারে আলোচনা করেছেন । পরিশেষে Geoffrey Miller এর লেখা এক গবেষণা পত্রের উল্লেখ করি যেখানে তিনি শৈল্পিক গুণাবলী এবং শৈল্পিক রসবোধ ও বিচারজ্ঞানকে যৌণ নির্বাচন দ্বারা ব্যাখ্যার প্রয়াস করেছেন। এই গবেষণা পত্রের বিস্তারিত পড়তে চাইলে পাঠকেরা এই সাইটে ক্লিক করতে পারেনঃ http://www.unm.edu/~psych/faculty/aesthetic_fitness.htm কিছু বই, প্রবন্ধ ও গবেষণা পত্রের নির্দেশিকাঃ 1. The Artistic Animal: an Inquiry into the Biological Roots of Art by Alexander Alland Jr., Anchor Books, 1977 2. Evolutionary Aesthetics, edited by Eckart Voland and Karl Grammer Heidelberg: Springer Verlag, 2003. 3. The Bard on the Brain: Understanding the Mind through the Art of Shakespeare and the Science of Brain Imaging by Paul Matthews and Jeffrey McQuain, Univ. Chicago Press, 2003 4. The Biological Foundations of Music edited by Robert Zatorre and Isabelle Peretz, New York Academy of Sciences, 2001 5. Cross-Pollinations: the Marriage of Science and Poetry by Gary Paul Nabhan, Milkweed Press, 2004 6. Evolution and Literature - D.A Evans, South Dakota Review. 7. Connections: the Geometric Bridge between Art and Science by Jay Kappraff, McGraw Hill, 1991 8. Einstein, Picasso: Space, Time and the Beauty that Causes Havoc by Arthur I. Miller, Basic Books, 2001 9. Where mathematics comes from; How the embodied mind brings mathematics into being - Lakoff & Nunez (2000) 10. Physics and Music: the Science of Musical Sound by Harvey White and Donald White, Holt Rinehart Winston, 1980 11. Physics and Psychophysics of Music by Juan Roederer, Springer Verlag, 1995 12. Physics of Musical Instruments by Norman Fletcher and Thomas Rossing, Springer Verlag, 1998