স্বাধীন ইচ্ছা, মন্দ ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব - অপার্থিব জামান ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিপক্ষে একটা ক্ষতিকারক যুক্তি হল মন্দের (নৈতিক ও প্রাকৃতিক) যুক্তি ( Argument from Evil) যা কিনা বলে যে, জগতে মন্দের উপস্থিতি ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করে কারণ মন্দের উপস্থিতি পরমকরুনাময়তার (Omnibenevolence) বিরোধী, আর পরমকরুনাময়তা ঈশ্বরের একটি সংজ্ঞায়ক গুণ। ধর্মবাদীরা (Apologists) এই যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দেন যে, মন্দ স্বাধীন ইচ্ছার অবশ্যম্ভাবী ফল। ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী করার ফলেই মন্দের উদ্ভব। মন্দ মানুষের নিজের সৃষ্টি, তার স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা। সংজ্ঞা অনুযায়ী ঈশ্বর সর্বশক্তিমান (Omnipotent) , পরমকরুনাময় এবং সর্বজ্ঞ (Omniscient) । এখন সমস্যা হল ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞই হন তাহলে কেঊ আগামীকাল কি করবে তা ঈশ্বরের আজই জানার কথা। কিন্তু তা হবে স্বাধীন ইচ্ছার পরিপন্থী, কারণ, আগামীকাল আমি কি করব সেটা ঈশ্বর বা অন্য যে কারো আজ জানা থাকার মানেই হচ্ছে আমার কাজটা পূর্বনির্ধারিত। কারণ কেউ যদি আগামীকাল কোন একটি কাজ করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে থাকে, তা হলে সেই কাজটা ঈশ্বরের জানা কাজটাই হতে হবে, অন্য কোন কাজ নয়। সে শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করে অন্য কোন কাজ করতে পারেনা। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীন ইচ্ছায় শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করার অধিকার দেয়ারই কথা । কাজেই স্বাধীন ইচ্ছা ও ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা পরস্পর বিরোধী। ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা স্বীকার করলে স্বাধীন ইচ্ছা অস্বীকার করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আর একটা সমস্যা হল কেউ যদি কোন অপকর্ম করে তাহলে সেটা পূর্বনির্ধারিত, আমরা আগেই তা দেখেছি। কিন্তু কার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত? নিশ্চয় ঈশ্বর। মানুষের অপকর্ম যদি ঈশ্বর নির্ধারিত হয় তাহলে ঈশ্বর পরমকরুনাময় নন। আর যদি ঈশ্বর নির্ধারিত না হয় তাহলে অবশ্যই প্রকৃতি নির্ধারিত, সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এবার ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি (Free Will Defense) নিয়ে আলোচনা করা যাক। তার আগে আস্তিকতার বিরুদ্ধে মন্দের যুক্তির সারাংশ বর্ণনা দিয়ে রাখি: মন্দের যুক্তি: ১। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বকরুনাময় এবং সর্বজ্ঞ (আস্তিকদের দাবী) ২। ঈশ্বর যেহেতু সর্বজ্ঞ, সেহেতু ভবিষ্যৎ মন্দ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ৩। ঈশ্বর যেহেতু সর্বকরুনাময়, মন্দ নিবারণ ই তাঁর অভিপ্রায় ৪। ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিমান, মন্দ নিবারণ তাঁর পক্ষে সম্ভব ৫। ২,৩,৪ অনুযায়ী মন্দের উপস্থিতি ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করে ৬। পৃথিবীতে মন্দ আছে ৭। ৫ এবং ৬ অনুযায়ী ঈশ্বর (১ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী) অনুপস্থিত সংশয়বাদী ও নাস্তিকেদর উপেরাক্ত মন্দের যুক্তির বিপেক্ষ আস্তিকরা স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি দেন, যার সারাংশ হল: স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি: ১। ঈশ্বরের নিকট দুটো বিকল্প খোলা অছে: (ক) স্বাধীন ইচ্ছাপূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করা (খ) স্বাধীন ইচ্ছাবিহীন মানুষ সৃষ্টি করা ২। যদিও স্বাধীন ইচ্ছা থাকার হেতু মানুষের মন্দ কাজ করার সম্ভাবনা ঈশ্বরের পক্ষেও অনিবার্য, আর অন্যদিকে স্বাধীন ইচ্ছাবিহীন মানুষেক মন্দ কাজে অক্ষম করা ঈশ্বরের পক্ষে সম্ভব, তথাপি স্বাধীন ইচ্ছা থাকা স্বাধীন ইচ্ছা না থাকার চেয়ে শ্রেয়। ৩। ঈশ্বর অবশ্যই যা শ্রেয় তাই করেন ৪। উপরের ২ এবং ৩ এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্দ কাজে সক্ষম স্বাধীন ইচ্ছাপূর্ণ মানুষ সৃষ্টি ছাড়া ঈশ্বরের কোন বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যবশত: উপেরাক্ত স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তির কয়েকটি ত্রুটি ধরা পড়ে প্রথমত, স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে মন্দ কাজ করার সক্ষমতা যে স্বাধীন ইচ্ছার অভাব হেতু মন্দ কাজ করার অক্ষমতার চেয়েও শ্রেয় তা বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। যারা মন্দ কাজের দ্বারা উপকৃত হয় শুধু তারাই এটায় সম্মতি জানাতে পারে। যারা মন্দের শিকার (সংখ্যাগুরু) তারা কখনই এটা মানবে না। আস্তিকদের আর একটি যুক্তি হল, স্বাধীন ইচ্ছা বিহীন মানুষ, যারা মন্দ কাজ করার ইচ্ছা পোষণেও অক্ষম, তারা রোবট সদৃশ। আস্তিকদের এই যুক্তির বিপক্ষে প্রশ্ন করা যায় যে স্বাধীন ইচ্ছা পূর্ণ মানুষ যদি স্রেফ ঈশ্বরের আদেশ বা ইচ্ছার বশবর্তী হয়েই সর্বদা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলে সেও কি একটা রোবট নয়?। অথচ সেরকম মানুষই ঈশ্বরের বা আস্তিকদের দৃষ্টিতে পূণ্যবাণ। কিন্তু মন্দ কাজে অক্ষম স্বাধীন ইচ্ছা বিহীন রোবট কি মন্দ কাজে সক্ষম স্বাধীন ইচ্ছা পূর্ণ রোবটের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়? দ্বিতীয়ত উপরের ২ নং যুক্তিতে "শ্রেয়" বলার অর্থ এই যে আস্তিকরা ঈশ্বরের মনের কথা যানেন। ঈশ্বর কোন্ ব্যাপারটাকে শ্রেয় মনে করেন তা মানুষের জানার কথা নয়। আস্তিকেদর এটা বলা কার্যের পর কারণ খোঁজার শামিল। মন্দ আছে বলেই তাদের এই যুক্তি। যদি এমন হত যে জগতে কোন মন্দ নেই তাহলে তারা যুক্তি দিতেন যে, ঈশ্বর যেহেতু পরমকরুনাময়, তাই মন্দ বলে কিছু নেই! আর এক আস্তিক দর্শন বলে যে, ভাল বা শুভ এর অর্থবহতার জন্যই মন্দ বা অশুভের প্রয়োজন। মন্দ বা অশুভ ব্যতিরেকে ভালো বা শুভ যেহেতু অর্থহীন, সেহেতু মন্দ বা অশুভ সম্পূর্ণ দূর করা ঈশ্বরের পক্ষে যেমনি অসম্ভব তেমনি যুক্তিহীন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বর কেন পূণ্য কাজের উপেদশ দেন ও পূণ্য কাজ না করলে শাস্তির ভয় দেখান? স্পষ্টত সবাই যদি শুধু পূণ্য কাজ করে, তাহলে একই যুক্তিতে ভালো বা শুভ এর অর্থবহতা থাকেনা। কাজেই ভালর অর্থবহতার জন্য ঈশ্বরকে কিছু মন্দের নিশ্চয়তা বিধান করতেই হবে। কিন্তু আবার সেই মন্দের জন্য মানুষকে ঈশ্বর শাস্তি দেবার বিধানও দেন। কাজেই একটা অসঙ্গতি থেকেই যাচ্ছে। আস্তিকদের এই যুক্তির আর একটা বিপজ্জনক দিক হল, কেউ কোন অপকর্ম করলে এই বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে যে, অপকর্মটা তার নিজের কারণে নয়, ঈশ্বরের কিছু মন্দের নিশ্চয়তা বিধানই তার অপকর্মের কারণ! ভালর জন্য কিছু মন্দের প্রয়োজন আবশ্যকীয় হলে প্রশ্ন ওঠে স্বর্গে কেন অনাবিল সুখের প্রতিশ্রুতি? আর একটা প্রশ্ন ওঠে যে ভালর অর্থবহতার জন্য নিরপরাধ শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণের মত মন্দের কি প্রয়োজন? আর তাছাড়া সেটা কি পরমকরুনাময়তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় কি? আর একটি ত্রুটি হল, স্বাধীন ইচ্ছা মানেই মন্দ করার সম্ভাবনা নিশ্চিত করা, আস্তিকেদর এটা ধরে নেয়া। কিন্তু আসলে স্বাধীন ইচ্ছার অর্থ হল কয়েকটি বিকল্পের মধ্যে যে কোন একটা বেছে নেয়ার ক্ষমতা। কিন্তু বিকল্প মন্দই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। স্বাধীন ইচ্ছা কয়েকটি ভালো বিকল্পের মধ্যে যে কোন একটা বেছে নেয়ার ক্ষমতাও ত হতে পারে। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান, পরমকরুনাময় ই হন তাহলে মন্দ বিকল্পগুলি অপসারণ করে শুধু ভালোগুলো রাখতে পারতেন না কি?। চিন্তা করার বিষয়। কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে মন্দ করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বিকল্পের সংখ্যা সীমিত করলে স্বাধীন ইচ্ছাকেই খর্ব করা হয়। এর উত্তরে বলা যায় যে মন্দ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তো অনেক কিছু করার ক্ষমতা মানুষের নেই, যেমন, যন্ত্রের সাহায্য ব্যতিরেকে উড়ে বেড়ান, বা নিজেকে অদৃশ্য করা। কাজেই মন্দ করার ক্ষমতা কেড়ে নিলে গুণগত কোন তফাৎ হবে না। একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত যে স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তির দ্বারা মন্দের সঙ্গে ঈশ্বরের গুণাবলির সামঞ্জস্য প্রমাণে আস্তিকদের চেষ্টায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিন্তু প্রমাণিত হয় না। যেমন আমি যদি যুক্তি দেই যে আমার একশ ফুট উচ্চতা লাফানর দাবীর সঙ্গে আমার ঘন্টায় একশ মাইল বেগে দৌড়ানর দাবীর কোন বিরোধ নেই, আমার এই যুক্তি সঠিক হলেও এটা প্রমাণিত হয় না যে আমি একশ ফুট উচ্চতা লাফ দিতে পারি বা ঘন্টায় একশ মাইল বেগে দৌড়াতে পারি। আরেকটা বিবেচ্য বিষয় হল যে মানুষের মন্দ কাজ করার কারণ কিছুটা বংশাণু (Gene) জনিত, আর কিছুটা পরিবেশ জনিত। যেহেতু এ দুটোর কোনটাই একজন মানুষের আয়ত্তে নয়, সত্যিকার অর্থে মন্দ কাজের দায়িত্ত্ব ঈশ্বর মানুষের ঘাড়ে চাপাতে পারেন না নীতিগতভাবে। এতক্ষণ আমরা নৈতিক মন্দের কথাই আলোচনা করেছি, যা মানুষ করতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত মন্দ? মানুষ কৃত মন্দ না হয় স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, যদিও তা ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিসের দ্বারা ব্যাখ্যা করবেন আস্তিকরা? প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত মন্দ, ঈশ্বরের পরমকরুনাময়তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় কি? আস্তিকরা যুক্তি দেন, এটার দ্বারা ঈশ্বর মানুষকে পরীক্ষা করেন। প্রশ্ন ওঠে কোন মানুষকে? যারা বেঁচে রইল? কিন্তু যারা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা গেল তারা তো এর আগের কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেঁচে ছিল। পরীক্ষার কোন সুফল তো তারা পেলো না। আজ যারা বেঁচে রইল তাদের অনেকেই তো ভবিষ্যতের কোন দুর্যোগে মারা যেতে পারে। এধরনের পরীক্ষার অর্থ কি তা হলে? আর এক দল আস্তিকরা বলেন, এগুলো হচ্ছে ঈশ্বরের এক গভীর লীলা খেলা। আমরা যা মন্দ বলে মনে করি তা আসলে ঈশ্বরের বৃহত্তর ভালরই অংশ। আমাদের অজ্ঞতার জন্যই আমরা তা বুঝতে পারিনা। যারা এই যুক্তি দেন প্রশ্ন ওঠে তারা ই বা ঈশ্বরের এই গভীর বৃহত্তর কারণের কথা জানলেন কেমন করে? উপরন্তু এর প্রত্যুত্তের এটাও তো ঘুরিয়ে বলা যায় যে আমরা যা ভাল মনে করছি সেটা আসলে ঈশ্বরের বৃহত্তর মন্দেরই অংশ। এই যুক্তি অন্যটার চেয়ে কোন অংশে কম অকাট্য নয়। মুশকিল হল এইরকম যুক্তি হল ঘটনার পরে কারণ খোঁজা। যদি জগতে কোন মন্দ না থাকতো তাহলেও বলা যেত যে ঈশ্বর দয়ালু সেহেতু মন্দ নেই। কিন্তু মন্দ আছে বলে তারা যুক্তি দেয় যে মন্দ হচ্ছে ঈশ্বরের এক অজ্ঞাত কারণ জনিত ভালর অংশ। অর্থাৎ কার্য যাই হোক না কেন কার্যের সঙ্গে সঙ্গতি মিলিয়ে কারণ খোঁজা হচ্ছে। কাজেই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হচ্ছি যে মন্দের অস্তিত্ব ও স্বাধীন ইচ্ছা ঈশ্বরের পরমকরুনাময়তা, সর্বশক্তিমত্তা আর সর্বজ্ঞতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।